জীবনের জন্য সাঁতার

ফারিয়া আক্তার, জিদান সিকদার, রিতু আক্তার, মনিরুল ইসলাম। তারা এবার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ৮ থেকে ১০ বছরের এই শিশুরা কিছুদিন আগেও সাঁতার জানত না। এখন অনায়াসেই ছোটখাটো পুকুর-ডোবা সাঁতরিয়ে পার হয়। এই শিশুদের বাড়ি উপকূলীয় অঞ্চলে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন এবং বরগুনা জেলার বেতাগী ও তালতলী উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে চলছে সাঁতার শেখানোর কার্যক্রম। এরই মধ্যে কলাপাড়া উপজেলার সাড়ে চার হাজার শিশু-কিশোরকে সাঁতার শেখানো হয়েছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) নামে একটি বেসরকারি সংস্থা। অস্ট্রেলিয়ার দ্য জর্জ ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল হেলথের কারিগরি সহায়তায় এতে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাজ্যের দ্য রয়াল ন্যাশনাল লাইফবোর্ট ইনস্টিটিউশন।
কলাতলীর টিয়াখালী ইউনিয়নের বাদুরতলী গ্রামে গিয়ে দেখা মিলল এমন একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বলতে গ্রামের একটি পুকুরের মধ্যে ১৮ ফুট দৈর্ঘ্যের এবং ৯ ফুট প্রস্থের চার কোনাকৃতির বাঁশ দিয়ে ঘেরা জায়গা। এ জায়গাটুকুর নিচে একই মাপের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে বাঁশ দিয়ে। সাঁতার শেখার প্রথম ধাপ এখানেই সম্পন্ন হয়। এটাকে তারা বলছে কৃত্রিম ‘সুইমিংপুল’।
তা ছাড়া এ প্ল্যাটফর্মের বাইরে ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি জায়গার মধ্যে বাঁশ দিয়ে আরও একটি ঘেরা দেওয়া হয়েছে। এটা হচ্ছে সাঁতার শেখার দ্বিতীয় ও সর্বশেষ ধাপ। এ ধাপে শিশুদের ‘সুইমিং কিক বোর্ড’ দেওয়া হয়। বুকের নিচে কিক বোর্ড নিয়ে সাঁতার কাটে শিশুরা। সাঁতার শেখার সর্বশেষ ধাপ হিসেবে একটি শিশু ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যের বাঁশ ঘেরা সীমানার মধ্যে পরপর দুবার সাঁতার দিয়ে দক্ষতা দেখাতে পারলে ‘সুইমিং গ্র্যাজুয়েট’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
সাঁতার প্রশিক্ষক মালা আক্তার বলেন, ‘সাঁতার শেখানোর পদ্ধতিগত প্রশিক্ষণ আমি আগে নিয়েছি, এখন শিশুদের শেখাচ্ছি। সাঁতার শেখানোর বিষয়টি উপভোগ করছি। আমার এলাকার কোনো শিশু যেন পানিতে ডুবে মারা না যায়, আমি সেটাই চাই।’
এই প্রশিক্ষকেরা একজন শিশুকে সাঁতার শেখানো বাবদ ১২০ টাকা সম্মানী পান। কথা বলে জানা গেল, প্রশিক্ষক হিসেবে কলেজের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে; যাদের অনেকেই নারী।
সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) উপজেলা সমন্বয়কারী মোহাম্মদ সেলিম মিয়া বলেন, ২০১৮ সালের মধ্যে কলাপাড়া উপজেলার ৩০ হাজার শিশু-কিশোরকে সাঁতার শেখানো হবে। এ ছাড়া কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে একটি জরিপ করে দেখা হবে, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কতটুকু কমেছে।

সাঁতার শেখানোর জন্য ১৫ জনের একটি দল গঠন করা হয়। তাদের মধ্য থেকে পাঁচজন করে পুকুরে নামিয়ে সাঁতার শেখানো হয়। ১৫ দিনের মতো সময় লেগে যায় একজন শিশুর সাঁতার রপ্ত করতে। শিশুদের স্কুলের সময় বিবেচনা করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সাঁতারের সঙ্গে আরও দুটি বিষয় শেখানো হয় ১. পানিতে পড়ে গেলে দীর্ঘ সময় ভেসে থাকার কৌশল; ২. পানিতে কেউ ডুবে গেলে তাকে উদ্ধার করা।
এমন উদ্যোগ সম্পর্কে কলাপাড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তানভীর রহমান বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলে পানিতে ডুবে প্রায়শই শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মানুষের জীবন রক্ষায় সাঁতার শেখানোর উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। আমরাও এ কাজে সহযোগিতা করছি।’
সাঁতারের সঙ্গে ‘আঁচল’
শিশুদের সুরক্ষার জন্য সাঁতার কেন্দ্রের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে দিবাযত্ন কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রের নাম দেওয়া হয়েছে আঁচল। কলাপাড়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে ১৪০টি আঁচল কেন্দ্র রয়েছে। ১ থেকে ৫ বছরের শিশুকে এসব কেন্দ্রে রেখে সুরক্ষা দেওয়া এবং সচেতন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। কেন্দ্র পরিচালনায় যিনি এ কাজ করেন তাঁকে ‘আঁচল মা’ বলা হয়। তাঁর সঙ্গে একজন সহকর্মী থাকেন। আঁচল মা এ সময়ে শিশুদের ছড়া, ছড়া গান, গল্প বলা, ছবি আঁকা শিখিয়ে থাকেন। শিশুদের রং-পেনসিল, খাতা দেওয়া হয়। এর বাইরে প্রত্যেক শিশু পায় টিফিন বক্স, পানির জগ, গ্লাস, মগ, সাবান, তোয়ালে। শিশুদের জন্য নানা ধরনের খেলার আয়োজনও থাকে। ঠিকমতো দাঁত ব্রাশ করা, খাবারের আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়াসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিও শিশুদের শেখানো হয়। আঁচল মা শিশুদের মনোসামাজিক সুরক্ষার কাজটি পরম মাতৃস্নেহে করে থাকেন। দুপুর ১টার পরে কেন্দ্র থেকে বাবা-মা এসে শিশুদের নিয়ে যায়।
একজন আঁচল মা নন্দিতা সিকদার বলেন, ‘সাধারণত সকাল ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত সময়ে বাবা-মা নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত থাকেন। এ সময় সারা দেশে ৭০ শতাংশ শিশু পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে। আমরা ওই হিসাব করে শিশু সুরক্ষায় এ রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।’