জীবনে বড় হওয়ার মন্ত্র হলো—ধরে রাখো আর ছেড়ে দাও

গত ১৮ মে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মার্কিন সংগীতশিল্পী ও গীতিকার টেইলর সুইফটকে দেওয়া হয়েছে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি। অনুষ্ঠানে দারুণ এক বক্তৃতাও দিয়েছেন জনপ্রিয় এই গায়িকা।

সমাবর্তন অনুষ্ঠানে টেইলর সুইফট
ছবি: রয়টার্স

শেষবার এত বিশাল স্টেডিয়ামে আমি এসেছিলাম বড় বড় হিল জুতা পরে নাচতে। আমার পরনে ছিল ঝলমলে পোশাক। ওসবের তুলনায় আজ এই সমাবর্তনের পোশাকে বেশ আরাম বোধ হচ্ছে।

আমাকে ‘ডক্টর’ বানিয়ে দেওয়ার জন্য নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিকে বিশেষ ধন্যবাদ দিতে চাই। হ্যাঁ, এই ‘ডক্টর’ হয়ে জরুরি অবস্থায় কাউকে চিকিৎসা অবশ্য দিতে পারব না। তবে কেউ যদি জরুরি ভিত্তিতে গান শুনতে চান, সেটা পারব।

কেউ যেচে এসে জিজ্ঞেস না করা পর্যন্ত কাউকে আমি উপদেশ দিতে পছন্দ করি না। অতএব আজও দেব না। আমার ধারণা, আমাকে এখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে নিজের অভিজ্ঞতা শোনানোর জন্য। এটা মাথায় গেঁথে নাও যে কোনোভাবেই তোমাদের উপদেশ দেওয়ার যোগ্য আমি নই। আমি জানি, তোমরা আমার চেয়ে সুন্দরভাবে, গুছিয়ে জীবনকে সাজাবে।

তাই জীবনে কী করতে হবে, কী করবে না, এ–সংক্রান্ত কোনো জ্ঞান আমি দেব না। কেউ এটা পছন্দও করে না। বরং আমি তোমাদের জীবন সহজ করে দেওয়ার মতো কিছু বুদ্ধি, কিছু টোটকা শিখিয়ে দেব। এসব পরামর্শ আমার জীবন থেকে নেওয়া। যখন আমি আমার স্বপ্নকে আমার পেশা হিসেবে নিচ্ছিলাম, যখন আমি আমার কাজ, পরিবার, প্রেম, পছন্দ, সিদ্ধান্ত, আশা, হতাশা, লজ্জা, আকাঙ্ক্ষা, আর বন্ধুত্ব—সব সামলে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন এসব কৌশল আমার জীবন সহজ করেছে।

ধরে রাখো, ছেড়ে দাও

জীবন মাঝেমধ্যে খুব ভারী হয়ে ওঠে। বিশেষ করে তুমি যখন একই সঙ্গে সব সামলাতে চাও, সব ধরে রাখত চাও। জীবনে বড় হওয়ার আর এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম মন্ত্র হলো—ধরে রাখো আর ছেড়ে দাও। যাঁরা জীবনে একবার বুঝে ফেলতে পারেন—কী ধরে রাখতে হবে আর কী ছেড়ে দিতে হবে, জীবনটা তাঁদের জন্য খুব সহজ। একই সঙ্গে তুমি জীবনের সব বোঝা, সব দুঃখ, সব পাওয়া, না পাওয়া বয়ে বেড়াতে পারবে না। তুমি নিজে ঠিক করে নাও, কোনটা তোমার কাছে ধরে রাখার মতো, কোনটা ছেড়ে দিয়ে হালকা হওয়ার মতো। বেশির ভাগ সময় জীবনের সুন্দর ব্যাপারগুলো হালকা হয়। আর বাজে সম্পর্ক, বাজে স্মৃতি আর অভিজ্ঞতার ওজন হয় অনেক বেশি। তাই, সব সুন্দর আর সুখস্মৃতিকে জীবনে ধরে রেখে, বাজে ব্যাপারগুলো ছেড়ে দিলে জীবন সহজ হয়ে যায়। সহজ আর জটিল বেছে নেওয়ার ব্যাপারে বিচক্ষণ হও।

সমাবর্তন অনুষ্ঠানে টেইলর সুইফট
ছবি: রয়টার্স

অদ্ভুত, কিন্তু অস্বাভাবিক নয়

জীবনের অদ্ভুত দিকগুলো মেনে নাও। তুমি যতই উদ্ভট ব্যাপার এড়িয়ে চলতে চাও না কেন, এগুলো তোমাকে ছাড়বে না। হলফ করে বলতে পারি, এখন তুমি যে পোশাক পরে আছ, যেমন সাজে আছ, কয়েক বছর পর এই সাজপোশাক তোমার কাছে উদ্ভট লাগবে। এই যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে অদ্ভুতভাবে আবিষ্কার করা, চাইলেও কিন্তু এটা এড়ানো যাবে না। আমার কথাই ধরো। ২০১২ সালজুড়ে আমি এমনভাবে সাজতাম। সেই সময়কার ছবি দেখলে মনে হয়, ১৯৫০ সালের কোনো এক গৃহবধূ। তবে সত্যি বলছি, ওই সময় ওভাবে থাকতে আমার ভীষণ ভালো লাগত। এখন উদ্ভট লাগে। আবার ভালোও লাগে এই ভেবে যে আমি আমার মনের মতো করে থাকতে পেরেছি, চলতে পেরেছি, আনন্দ নিয়ে জীবন উপভোগ করেছি। পেছনে ফিরে কোনো আক্ষেপ পাইনি।

আমরা বহুরূপী লেখক

১২ বছর বয়স থেকে আমি গান লেখা শুরু করি। তখন থেকে এটিই আমার জীবনের কম্পাস। বিনিময়ে জীবন আমাকে গান লেখার রসদ দিয়েছে। আমি যা-ই করি না কেন, হোক সেটা কোনো ভিডিও পরিচালনা, মঞ্চে পরিবেশনা, সবই আমার লেখালেখির একটা সংযোজিত অংশ।

একজন গীতিকার হিসেবে আমি কখনোই স্থির হয়ে বসতে পারিনি কিংবা সৃজনশীল কাজ করার মতো কোনো জায়গায় দীর্ঘক্ষণ থাকতে পারিনি। এখন পর্যন্ত ১১টা অ্যালবাম বের করেছি। কান্ট্রি, পপ, অলটারনেটিভ থেকে শুরু করে ফোক, নানা ধরনের গান লিখেছি। আমি মনে করি, কোনো না কোনোভাবে আমরা সবাই লেখক। ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে আমাদের লেখার ধরন ভিন্ন। থিসিস পেপার তুমি যেভাবে লেখো, ইনস্টাগ্রাম স্টোরি সেভাবে লেখো না। বসকে লেখা ই–মেইল আর বন্ধুকে লেখা চিঠিতে তোমার লেখার ধরন আলাদা। আমরা সবাই বহুরূপী লেখক, আর আমার কাছে এটা দারুণ মনে হয়।

সমাবর্তন অনুষ্ঠানে টেইলর সুইফট
ছবি: রয়টার্স

হারানো মানেই হারানো নয়

আগেই বলেছি, কেউ যেচে না চাইলে আমি উপদেশ দিই না। কেন, সেটা বলি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ক্যারিয়ার শুরু করার কারণে আমাকে বছরের পর বছর অনেক অযাচিত উপদেশ শুনতে হয়েছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে সংগীতশিল্পের যেকোনো আয়োজনে আমি ছিলাম ঘরের সর্বকনিষ্ঠজন। গণমাধ্যম, সাক্ষাৎকারগ্রহীতা, নির্বাহী থেকে শুরু করে সংগীতশিল্পের বয়োজ্যেষ্ঠজন, প্রত্যেকে আমাকে শুধু পরামর্শ দিয়ে গেছেন। পরামর্শের পাতলা ঘোমটার আড়ালে আদতে তা সাবধানবাণী। আমার যখন টিনএজ বয়স, তখন আমাদের সমাজ একজন তরুণ নারী রোল মডেল খুঁজতে মুখিয়ে ছিল। যত সাক্ষাৎকার আমি দিয়েছি, সবাই ঘুরেফিরে বলতে চেষ্টা করেছেন, একদিন আমি ছিটকে পড়ব। অতএব বড় হওয়ার পথে আমি এমন একটা বার্তা পেয়েছি যে আমি কোনো ভুল না করলেই যেন আমেরিকার সব শিশু দেবশিশুর মতো নিখুঁত হয়ে বেড়ে উঠবে। আমার পা পিছলে গেলেই
যেন পৃথিবী তার কক্ষপথ হারাবে,
আর সে জন্য একমাত্র আমি দায়ী থাকব। মূল কথা হলো—ভুল করা মানেই ব্যর্থ হওয়া। কোনো ভুল করলে তো তুমি একটা সুখী জীবনের সুযোগ হারালে।

কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে, আদতে তা নয়। বরং আমি দেখেছি, ভুলগুলোই আমাকে জীবনের সেরা বিষয়গুলো পাওয়ার দিকে ধাবিত করেছে। সবকিছু গুবলেট করে ফেলে লজ্জিত হওয়াটা তো মানুষের অভিজ্ঞতারই অংশ। আবার উঠে দাঁড়ানো, গায়ের ধুলা ঝেড়ে আশপাশে তাকিয়ে দেখা যে কে এখনো তোমার পাশে আছে—এটা একটা উপহার। যতবার আমি বাদ পড়েছি, ‘না’ শুনেছি, হেরে গেছি, পারিনি...পেছনে ফিরে মনে হয়, ‘হ্যাঁ’ শোনার চেয়ে ওই মুহূর্তগুলোই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আশপাশের বন্ধুরা যখন রাত জাগা পার্টিতে আমাকে দাওয়াত দেয়নি, আমি আশাহত হয়েছি, একাকিত্বে ভুগেছি। কিন্তু ওই একাকী সময়েই ঘরে বসে আমি সেই সব গান লিখেছি, যা আমাকে অন্য কোথাও পৌঁছানোর টিকিট দিয়েছে। ‘কান্ট্রি মিউজিক শুধু ৩৫ বছর বয়সী গৃহবধূরা শোনে’—১৩ বছর বয়সে এমন কথা শুনে বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে বসে আমি কেঁদেছি। কিন্তু এরপরই আমি মাইস্পেসে আমার গান পোস্ট করেছি, যেখানে কান্ট্রি মিউজিক পছন্দ করে এমন অসংখ্য তরুণ–তরুণী আমাকে বার্তা পাঠিয়েছে।

আমি বলতে চাইছি, কিছু হারানো মানেই হারানো নয়। কিছু হারানো মানে কিছু পাওয়াও বটে।

আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি, ইচ্ছা, ভয়, ক্ষত, স্বপ্নই আমাদের পথ দেখায়। কখনো কখনো তুমি সব গুবলেট করে ফেলবে। আমিও
করব। আমার বেলায় তুমি হয়তো খবরটা ইন্টারনেটে পাবে। মোদ্দা কথা হলো, কঠিন সময় আসবে। কিন্তু আমরা কাটিয়ে উঠব। এ থেকে শিখব। আরও পরিণত হব।

ইংরেজি থেকে অনুদিত, সূত্র: বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট