ঝরা পাতার গল্প

যে খবর কষ্ট দিয়েছে অনেককে

১৯ বছরের বিবাহিত জীবন। সন্তানের মুখ দেখেননি নাসরিন আক্তার। সমাজের, পরিবারের সদস্যদের আঙুল তোলা ছিল তার দিকে। এই নিয়ে খোঁটা শুনতে হতো প্রায়ই। গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে বাসার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন নাসরিন আক্তার। ‘সন্তান না হওয়ায় খোঁটা, ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে নারীর মৃত্যু’ প্রথম আলোর ২৬ অক্টোবরের খবরের শিরোনাম তিনি। নাসরিনের খবর প্রকাশিত হয়। মানুষ একটু দুঃখভরা মনে তার কষ্টটা ভাবেন। কিন্তু এমন নাসরিন তো ঘরে ঘরে। কেউ মৃত হন শারীরিকভাবে। আর জীবন্মৃত থাকেন অনেকে। আমরা যদি একটু পেছন ফিরে দেখি, এমন ঘটনা অহরহ দেখতে পাব।

গত ৪ অক্টোবর ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে সন্তান না হওয়ায় স্বামী তালাক দেন রেখা আক্তারকে (২৪)। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন এই গৃহবধূ।

বিয়ের তিন বছরেও কেন বাচ্চা হচ্ছে না, এমন গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে গত ২ জানুয়ারি আত্মহত্যা করেন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের শিশির আক্তার (২৬)।

শিশির, রেখা, নাসরিনরা মরে গিয়েই হয়তো ‘বেঁচে’ যান! কিন্তু যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা একবুক দুঃখ-কষ্ট নিয়েই দিন যাপন করছেন। অপমান-কটাক্ষের সাক্ষী হয় তাঁদের প্রতিটি ক্ষণ। খুব কাছ থেকে আমি বেশ কয়েকজন নারীকে দেখেছি, যাঁরা দিনের পর দিন মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে টেনে চলেছেন নিজের জীবন। নিম্নবিত্তের মধ্যে যাঁরা বস্তিতে থাকছেন, মানুষের বাড়ি বাড়ি গৃহকর্মের কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে কোনো খোলসের আবরণ নেই। বাচ্চা হচ্ছে না, তার মানে এই নারী বাঁজা। ঘুম থেকে উঠে এই নারীর মুখ দেখা যাবে না। ভালো কোনো কাজে একে রাখা যাবে না, মুখের ওপর বলে দেন নিম্নবিত্তরা। এটা যে চিকিৎসা করা যায়, তা তাঁদের ধারণার বাইরে।

তাবিজ-কবচ, ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে যখন তাঁরা দেখেন বাচ্চা হচ্ছে না, তখন বউকে ছেড়ে দেওয়াই সমাধান মনে করেন স্বামী। মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করা কিংবা দিন এনে দিন খাওয়া নারীটি নিজের নিয়তি মেনে তাঁদের পথ বেছে নেন। ‘বাচ্চা অয় না, তাই জামাই ছাইড়া দিছে’—এই কথা বলতে কোনো রাখঢাক করতে হয় না। যত সমস্যা সব ভদ্রঘরে। বাচ্চা হচ্ছে না। পরিবারের সদস্যদের কটাক্ষ। বন্ধুমহলে সান্ত্বনার নামে আহা-উঁহু। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বংশের প্রদীপ দেখার বিলাপ। অনেক সময় সমস্যাটি স্বামীর থাকে। দীর্ঘদিন সন্তান না হওয়ায় চিকিৎসা নিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায় স্বামী প্রথমে নিজের চিকিৎসা নিতে চান না। তিনি ধরেই নেন এটা স্ত্রীর সমস্যা। সমাজবদলের সুর ধরে এখন চিকিৎসকের পরামর্শে স্বামীরা স্ত্রীদের সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন। যখন জানতে পারেন সমস্যাটি স্ত্রীর নয়, তার নিজের, তখন সেই পুরুষটি নীরব থাকেন। কিন্তু পারিবারিকভাবে গঞ্জনা সহ্য করতে হয় নারীকেই। যখন পুরুষের শারীরিক ত্রুটি থাকে, তখন তিনি নীরব থাকেন, আর পুরুষ যখন জেনে যান সমস্যা আসলে স্ত্রীর। তখন তাঁকে পায় কে? দ্বিতীয় বিয়ের মাধ্যমে বংশের প্রদীপের খোঁজে নামেন তিনি।

আয়নার উল্টো পিঠও আছে। স্ত্রীর শারীরিক ত্রুটির কারণে সন্তানের মুখ দেখতে পারবেন না জেনেও অনেক স্বামী সেটা খুব ইতিবাচকভাবে মেনে নেন। ভালোবাসার ঘরে অভাব থাকে না প্রশান্তির। কিন্তু বাদ সাধে পরিবার, সমাজ। তেমনই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন সাদিয়া সুলতানা (ছদ্মনাম)। সাদিয়া জানান, ‘আমার বিয়ে হয়েছে ১৭ বছর। বিয়ের চার বছরের মাথায় জানতে পারি আমি আসলে মা হতে পারব না। তারপরও দেশে, দেশের বাইরে আমরা অনেক চিকিৎসা নিয়েছি। একটা সময় বুঝতে পেরেছি আসলে চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য বরাদ্দ রাখেননি। আমার স্বামী খুব ইতিবাচক মানুষ। আমরা দুজন খুব ভালো আছি। নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, বাসায় পোষা বিড়াল আছে। হাঁটতে, বেড়াতে বা খুব ছোট্ট একটা বিষয়ও দুজন খুব উপভোগ করি। বিয়ের এত বছর পর এসেও। কিন্তু যখন আমরা হাসিখুশি থাকি, নিজেদের আনন্দে রাখার চেষ্টা করি, তখন আমাদের ঘরের মানুষই এমনভাবে তাকায় যে কী নির্লজ্জের মতো বেঁচে আছি আমি। নিয়তি মেনে ভালো থাকা যায়, কিন্তু অনেকেই সেটা বুঝতে পারে না।’

যেমনটা বুঝতে পারেননি নাসরিন, কলিরা। পরিবার, সমাজের মানুষের চোখের ভাষা, মুখের ভাষা ছিল কীভাবে নির্লজ্জের মতো বেঁচে থাকো? সেই ভাষার উত্তর দেন তাঁরা জীবন বিসর্জন দিয়ে। নাসরিন, কলি বুঝতে পারেননি, প্রকৃতির নিয়ম মেনে ভালো থাকা যায়। নিজেকে, নিজেদের ভালো রাখা যায়। সন্তান দত্তক নিয়ে, নিজেদের সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যে ব্যস্ত রেখে সময় সুন্দর করে কাটানো যায়। সুন্দর জীবনযাপন, মানুষের জাজমেন্টাল স্বভাব উপেক্ষা করে চলতে পারলে ভবিষ্যতে কলিরা অকালে ঝরে পড়বেন না।