ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো

নজরুল ছিলেন আপাদমস্তক স্টাইল আইকন। তাঁর পারিপাট্য ছিল দেখার মতো। পোশাক-আশাক আর অনুষঙ্গে তিনি যথাযথ। তাঁর সঙ্গে কেশসজ্জাও ছিল মানানসই।

কোক স্টুডিও বাংলায় কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ গজলটি সম্প্রতি গেয়েছেন সংগীতশিল্পী ঋতুরাজ। নকশার এ আয়োজনে মডেল হয়েছেন তিনি।টি–শার্ট: নিত্য উপহার, ছবি: সুমন ইউসুফ

নজরুলের ফ্যাশন বা হেয়ারস্টাইল নিয়ে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। কারণ, জীবনীকারেরা অনেক বিষয়ে আলোকপাত করলেও তাঁর বেশবাস নিয়ে আলোচনা করেননি। কিন্তু কবে থেকে তিনি এমন হেয়ারস্টাইলে অভ্যস্ত হলেন, তা নিয়ে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ১৯১৭ থেকে ১৯২০ সাল—এ সময়ে তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীতে। তবে ১৯২০ সালের মার্চে ‘ফোরটি–নাইনথ বেঙ্গলিজ’ ভেঙে যাওয়ার পর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন।

নজরুলজীবনীকারেরা বলছেন, তিনি ফিরেছিলেন প্রায় শূন্য হাতে। সঙ্গে ছিল শুধু লেপ–তোশক ও পোশাক-আশাক। এর মধ্যে ছিল সেনাপোশাক, শেরওয়ানি, ট্রাউজার ও কালো উঁচু টুপি। তখন তাঁর মাথায় বাবরি ছিল কি না, নিশ্চিত জানা যায় না। যদিও অনেকেই বলে থাকেন হাবিলদার পদে উন্নীত হওয়ার পর থেকেই তিনি বাবরি রাখতে শুরু করেন। কিন্তু এর সপক্ষে যেমন তথ্য মেলে না, তেমনি তাঁর তখনকার ছবিও সে সাক্ষ্য দেয় না; বরং তাঁকে মাঝে সিঁথি করতে দেখা যায়। আড়াআড়ি চাদর জড়ানো, মাঝে সিঁথি করা তরুণ নজরুলের একাধিক ছবি দেখা যায়।

বাংলাদেশে আসার পর সাধকসন্নিধান ও সংশ্লিষ্টতা হয়তো নজরুলকে এমন কেশসাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল
ছবি: সুমন ইউসুফ

তাই ঠিক কবে থেকে যে নজরুল বাবরি রাখছেন, সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। বাংলাদেশি লোকসংস্কৃতি গবেষক এবং নাট্যকার সাইমন জাকারিয়া মনে করেন, বাংলাদেশে আসার পর সাধকসন্নিধান ও সংশ্লিষ্টতা হয়তো নজরুলকে এমন কেশসাজে উদ্বুদ্ধ করে থাকবে। তিনি আরও জানান, সেই সময়ে নজরুলের সঙ্গে মঈন শাহের সাক্ষাৎ হয়েছিল।

নজরুলের চুল ছিল কাঁধ পর্যন্ত ঢেউখেলানো। আর কোঁকড়ানো। এই চুলকেই স্বাধীনতার সঙ্গে তুলনা করে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতা তুমি/ কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো/ মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা...।’

একসময় এই হেয়ারস্টাইলই ছিল পৌরুষের চিহ্ন
ছবি: সুমন ইউসুছ

‘বাবরি’ বা ‘বাবরী’ যেটাই হোক, এর অর্থ কাঁধ পর্যন্ত লম্বা কোঁকড়ানো চুল। নজরুলের এমনই ছিল। শব্দটি অনেকের মতে ফারসি। আর অর্থ বাঘ বা সিংহ। একসময় এই হেয়ারস্টাইলই ছিল পৌরুষের চিহ্ন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক চরিত্রেও দেখা যায় কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল। অনুষ্ঠানাদিতে এই চুলের ওপর নজরুল পরতেন কিস্তি টুপি। পাঞ্জাবি ও ধুতির সঙ্গে চাদর আর কিস্তি টুপি, এ–ই ছিল তাঁর স্বকীয় পোশাক স্টেটমেন্ট। গ্রামোফোন কোম্পানিতে যখন চাকরি করতেন, তখনো এটাই ছিল তাঁর বেশবাস। এভাবেই তাঁকে দেখেছেন প্রয়াত নজরুলসংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম। এমনকি যে ঘরোয়া আসরে প্রথম তিনি নজরুলকে দেখেন, সেখানেও ছিল এই সাজবেশ। কথা প্রসঙ্গে বেশ আগে বিষয়টি আমাকে জানিয়েছিলেন তিনি।

অসুস্থ হয়ে পড়ার পর নজরুলের চুল পড়ে যায়। মাথার সামনেটায় টাক পড়ে গেলেও পেছনে তখনো কাঁধ পর্যন্ত না থাকলেও কিছুটা লম্বা চুল ছিল।

বাবরি চুলের স্টাইল বারবার ফিরে আসে
ছবি: সুমন ইউসুফ

যাহোক, বাবরি চুল প্রসঙ্গে বলা যায়, বারবার ফিরে আসে এই স্টাইল। হালে তরুণদের অনেককেই এই বাবরি চুলে দেখা যাচ্ছে। আর এখন তো আবার চুলের জন্য রয়েছে যত্নের নানা ব্যবস্থা। তা সেটা যেমন নিজে বাসায় করা যায়, তেমনি ইচ্ছা হলে রূপসদনে গিয়েও যত্ন নেওয়া যায়। আছে নানা উপচারও। আর বর্তমানে চুলের পরিচর্যায় হচ্ছে নিয়মিত গবেষণা। মিলছে নানা ধরনের উপকরণ, যা চুলকে দূষণ থেকে রক্ষা করবে। রাখবে সতেজ ও ঝলমলে।

তাই ইচ্ছা করলে আপনিও এই হেয়ারস্টাইলে নিজেকে অনন্য করে তুলতে পারেন। আর কাল যেহেতু ১১ জ্যৈষ্ঠ, নজরুলের জন্মদিন, এদিনই হতে পারে বাবরি রাখতে শুরু করার মোক্ষম দিন।