টিএসসির সবুজ ঘাসের লেখা চিঠি

আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্ণ হলো। বিশেষ এই দিনে টিএসসির সবুজ ঘাসের হয়ে চিঠিটি লিখেছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র সঞ্জয় সরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি)
ছবি: আশরাফুল আলম

আমরা সবুজ ঘাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আমাদের বসবাস। আপনারা যে ঘাসের ওপর বসে মনের কথার ঝাঁপি খুলে দেন; আজ সেই ঘাসের মনের কথা শুনুন। আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কথা লালন করি। আজ আমাদের অবস্থা সদ্য প্রেমে পড়া যুবকের মতো। বুকে জমা আছে অনেক কথা, মুখে আসে না কিছুই। ভেবে পাচ্ছি না কোথা থেকে শুরু করা যায়।

নবীনদের দিয়েই শুরু করা যাক। তাঁদের আড্ডাগুলোই তো হয় সবচেয়ে প্রাণবন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে কেউ কাউকে চিনত না। অথচ দুই দিনের পরিচয়ে তাঁদের মধ্যে গড়ে ওঠে গভীর সখ্য, যেন তাঁরা জন্মেছিল একে অপরের জন্য।

কিন্তু হয়তো প্রকৃতির বেখেয়ালে এত দিন দেখা হয়নি। নবীনবরণ অনুষ্ঠানে একেকজনের সে কী উচ্ছ্বাস! প্রতিটি নবীনবরণ অনুষ্ঠানেই থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পরিবেশন করেন শিক্ষার্থীরা নিজেই।

কী সুন্দর তাঁদের পরিবেশনা! আমরা টিএসসির ঘাসেরা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি।

কখনো কখনো দেখা যায় কারও না কারও জন্মদিনে দলবেঁধে গান গায় সবাই। গ্রাম থেকে উঠে আসা সেই ছেলেটি বা মেয়েটি, যে হয়তো শুধু বাংলা সিনেমায় নায়িকার কেক কাটা দেখেছে, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে কোনো দিন এমন উদ্‌যাপনের কথা ভাবতে পারেনি, সে-ও বন্ধুদের সঙ্গে মজা করে কেক কাটে।

এ ক্ষেত্রে আবার তাদের মধ্যে একটা অলিখিত নিয়ম দেখতে পাই। যার জন্মদিন তার কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হয় না। অন্য বন্ধুরা টাকা তুলে জন্মদিন উদ্‌যাপনের ব্যবস্থা করে। বন্ধু বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মা-বাবার পেশা বা আর্থিক অবস্থা কোনো প্রভাব ফেলে না। যার যাকে ভালো লাগে, সে তার বন্ধু হয়ে যায়। অনেককেই দেখি কেক কাটার পর হঠাৎ করে বন্ধুকে জাপটে ধরে কেঁদে ফেলে। হয়তো অতীত আর বর্তমানের স্মৃতির মেলবন্ধন তাকে কাঁদতে বাধ্য করে।

সন্ধ্যায় এখানে এসে ভিড় করেন যেন শহরের সব কবি-সাহিত্যিকেরা। আমরা টিএসসির ঘাসেরা কবিতাও খুব পছন্দ করি। প্রতি সন্ধ্যায় দেখা যায় একদল তরুণ-তরুণী এখানে এসে মনের সুখে কবিতা আবৃত্তি করছেন। একেকজন একেক রকম কবিতা পাঠ করেন। কবিতা ও কবিতা পাঠের ধরন দেখে বোঝা যায় কার মনের কী অবস্থা।

অনেক বন্ধুত্বের সূচনা হয় এই টিএসসিতে
ছবি: আবদুস সালাম

আর হ্যাঁ, একটা কথা মনে করিয়ে দিতে ভুলে গেছি। এটা অবশ্য সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা সেই সব নবীন প্রেমিকদের জন্য, যাঁরা এইমাত্র গিটারের টুংটাং আওয়াজে ভালো লাগার মানুষটিকে গান শুনিয়ে হলে গিয়ে নির্ঘুম রাত্রি যাপন করছেন। প্রায় সময়ই দেখি নবীন প্রেমিকেরা গিটারের টুংটাং শব্দে ভালো লাগার মানুষটিকে গান শোনান। বেচারার হাত-গলা দুটোই সমানতালে কাঁপে। ফলে গানে না থাকে সুর, না থাকে লয়! আর গিটার বাবাজির তো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা!

কিন্তু মনে রাখবেন, মেয়েটি ভালোবাসে আপনাকে। আপনার গান কেমন হলো, সেটা কোনো ব্যাপার না। মূল বিষয় হচ্ছে, একসঙ্গে সময় কাটানো। গান এখানে একটা উপলক্ষমাত্র। আর ভাই, এটা আপনাকে বলে দিতে হবে কেন? গান শোনানোর পর যখন জিজ্ঞেস করেন ‘কেমন লাগল?’ তখন কি একবারও ওর চোখের দিকে তাকিয়েছেন? সে যে কী লাজুক চাহনি! মেয়েটির চলে যাওয়ার সময়ে তাঁকে একা ছাড়েন কেন? তাঁর বুঝি আপনার সঙ্গে সোডিয়াম বাতির নিচের আবছা অন্ধকারে নিঃশব্দে হাঁটতে ইচ্ছা করে না?

বাঁধনের কার্যক্রম দেখে বোঝা যায়, এই সংগঠনের সদস্যরা কতটা ভরসার পাত্র। এ রকম অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছে এই ক্যাম্পাসে। আছেন অনেক বিখ্যাত লোকজন। আজ আমরা তাঁদের গল্প করলাম না। কিছু ঘটনা বললাম, যেগুলো জীবনের সঙ্গে লেপ্টে থাকে। যেগুলো ভবিষ্যতের চলার পাথেয়। এ ঘটনাগুলোই বারবার করে মনে পড়বে ভবিষ্যতের যান্ত্রিক জীবনে। হয়তো দেখা যাবে গভীর দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ব্যালকনির গ্রিল ধরে। মনে হাজারো দুঃখগাথা। হঠাৎ দেখা গেল মুখে এক চিলতে হাসি। কারণ, হয়তো ক্যাম্পাসজীবনের কোনো ঘটনার কথা মনে পড়েছে।

আপনাদের ছোট ছোট ব্যথায় আমরা ঘাসেরা ব্যথিত হই। শুধু আমরা না, এই ক্যাম্পাসের পুরো প্রকৃতি এটা নিশ্চয়তা দেয় যে আপনার মনে হাজারো ব্যথা থাকলেও মন খারাপ করে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে হবে না; ব্যথা তাড়ানোর সব দুয়ার খোলা আছে। খুব খারাপ লাগে যখন কোনো ছুটিতে সবাই বাড়িতে যান। প্রাণ ছাড়া দেহ তো অসার। কোনো মূল্য নেই। আপনারা হলেন এই ক্যাম্পাসের প্রাণ। থাকুন প্রাণবন্ত। সব সময়।