টিকটকে পড়ালেখাও হয়
‘টিকটক’ শুনলেই অনেকে মুখ বাঁকা করেন। ভাবেন, নিশ্চয়ই নাচ-গান কিংবা অদ্ভুত সব ভিডিও আপলোডের প্ল্যাটফর্ম এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি। ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগোর বাংলাদেশি শিক্ষার্থী তাবাসসুম ইসলামও তেমনটাই ভাবতেন। কীভাবে তাঁরা ধারণা বদলে গেল, সেটাই লিখেছেন তিনি।
প্রথম টিকটক সম্পর্কে আমার ধারণায় পরিবর্তন আসে মিসেস কেলির ক্লাস করার পর। তিনি টেক্সাসের একটি স্কুলের গণিত শিক্ষক। মহামারির শুরুর দিকে আরও অনেকের মতো জুমের মাধ্যমে পড়াচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ক্রমে তাঁর মনে হতে থাকে, সত্যিকারের ক্লাসরুমে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের যে উচ্ছলতা টের পান, তা এই দূরশিক্ষণে একেবারে অনুপস্থিত। নিজের এই উপলব্ধির কথা মিসেস কেলি বলছিলেন এভাবে, ‘গণিতের সূত্র হয়তো তাদের ঠিকভাবেই বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম, তবে সবাই মিলে শেখার যে আনন্দ—তা সেখানে ছিল না।’
এই উপলব্ধি থেকেই@the_mrskelly নামে একটি টিকটক অ্যাকাউন্ট খোলেন তিনি। আর ১০ সেকেন্ডের ছোট ছোট ভিডিওর মাধ্যমে বোঝাতে শুরু করেন ধনাত্মক-ঋণাত্মক সংখ্যা, বিপ্রতীপ কোণ-সম্পূরক কোণ, সরল সমীকরণের মতো গণিতের খুঁটিনাটি। মাত্র এক সপ্তাহ পরই কেলির ‘মিনি ম্যাথ লেসন’–এর ফলোয়ারের সংখ্যা এক লাখ পেরিয়ে যায়। পেরোবে না কেন? সেখানে তো ধনাত্মক-ঋণাত্মক সংখ্যার সংজ্ঞা আর উদাহরণ দিয়েই ক্লাস শেষ হয়ে যাচ্ছে না। বরং বাজনার সঙ্গে ধনাত্মক আর ঋণাত্মক সংখ্যা কীভাবে নেচে বেড়ায়, তা-ও মজার সব অভিব্যক্তি দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন কেলি। কেলির নিজের ক্লাসের শিক্ষার্থীরা যেমন এই ভিডিওগুলো দেখে দারুণ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তেমনি বিশ্বের নানা প্রান্তের শিক্ষার্থীরাও কেলিকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখছে, ‘এত সহজ! এত মজার! তুমি বেস্ট!’
টিচার যখন টিকটকার
এবার আসুন একটু বিজ্ঞানের ক্লাসে উঁকি দিয়ে দেখি। নর্থ ক্যারোলাইনা পাবলিক স্কুলের শিক্ষিকা ন্যান্সি বসে আছেন তাঁর রান্নাঘরে। তাঁর সামনে রাখা একটি কাচের বোতল, কিছু ভুট্টার দানা, বেকিং সোডা, ভিনেগার আর পানি। মাত্র ১৩ সেকেন্ডে এই অল্প কিছু উপকরণ দিয়ে ‘আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত’ দেখিয়ে দিলেন তিনি। টিকটকের ফিচার ব্যবহার করে এতে তিনি যোগ করেছেন মজার মিউজিক ও লেখা। আবার কীভাবে, ভিনেগারের ঠিক কোন উপাদানের সঙ্গে বেকিং সোডার বিক্রিয়া থেকে তৈরি হলো এই আগ্নেয়গিরি, সেটিও একদম ঠিকঠাক বুঝিয়ে দিয়েছেন ন্যান্সি। ন্যান্সির বিজ্ঞান ক্লাসের নাম@mrs.b.tv, যেখানে ফলোয়ার ২.৭ মিলিয়ন।
পড়া বোঝানোর পাশাপাশি হোমওয়ার্ক বা অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রেও দারুণভাবে টিকটক ব্যবহার করছেন শিক্ষকেরা। যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা শহরে বসবাসরত রেবেকা পো সপ্তাহে একবার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রেজেন্টেশন নেন টিকটকে। বাজনার তালে তালে তারা পুরো ক্লাসের সামনে গণিতের জটিল সূত্র বোঝায়। আবার শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক ম্যাট হেড যখন বুঝলেন ভার্চ্যুয়াল ক্লাসে শিক্ষার্থীদের দৌড়ঝাঁপ করানো বেশ কঠিন, তিনি তৈরি করলেন সহজ কিছু চ্যালেঞ্জ। যেমন প্রথম সপ্তাহে তিনি শিক্ষার্থীদের ৬০ সেকেন্ড দড়িলাফের চ্যালেঞ্জ জানালেন। শিক্ষার্থীরাও স্টিকার, টেক্সট, মিউজিকসহ মজার সব ভিডিও বানিয়ে জমা দিয়েছিল ম্যাট হেডের ক্লাসে।
টিকটকই কেন
অনেক শিক্ষক আবার শিক্ষার্থীদের আনন্দ দেওয়ার জন্য, কিংবা দূর থেকেও সম্পর্কের আন্তরিকতাটা বজায় রাখার জন্য টিকটক ব্যবহার করেছেন। সান ডিয়াগোর শিক্ষক কেভিনের কথাই ধরা যাক। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হইহুল্লোড় করা, তাদের প্রত্যেকের গল্প শোনার ব্যাপারটি ভীষণ মিস করছিলেন কেভিন। তাই তাঁর শিক্ষকজীবনের অভিজ্ঞতা, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাটানো দারুণ সব মুহূর্তের গল্প টিকটকেই বলছেন তিনি। ক্লাসে বেশি কথা বলার জন্য প্রিয় বন্ধুর পাশ থেকে কাউকে উঠিয়ে দেওয়া কিংবা কোণের এক আসনে ‘নির্বাসনে’ পাঠানো—এমন শাস্তি তো আর ভার্চ্যুয়াল ক্লাসে দেওয়া যায় না। কেভিন তাঁর ১০ সেকেন্ডের টিকটক ভিডিওগুলোতে হাস্যকর অভিব্যক্তি, মজার মিউজিক আর টেক্সট দিয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছেন সেসব মুহূর্তের কথা। কেভিনের ফলোয়ারের সংখ্যা এখন ২২ লাখ, আর টিকটকে কেভিনকে খুঁজে পাবেন @mr.mctiktok নামে।
বাংলাদেশে টেন মিনিট স্কুলও কিন্তু টিকটকে বেশ সক্রিয়। শিক্ষামূলক ভিডিওগুলোই তাঁরা সেখানে তুলে দেন টিকটকের উপযোগী করে।
করোনাকালকে বলা হচ্ছে ‘অভূতপূর্ব সময়’। বদলে যাওয়া এই সময়ে পড়ালেখার নতুন নতুন ধরন তো উঠে আসবে। তবে অনেকে হয়তো বলবেন, ‘তাই বলে টিকটক কেন?’ এ প্রশ্নের উত্তরে কানাডার ব্রক ইউনিভার্সিটির চাইল্ড অ্যান্ড ইয়ুথ স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক শনা পমর্যান্টজে বলেন, ‘টিকটক হলো বর্তমান প্রজন্মের “লিঙ্গুয়া ফ্র্যাংকা”, (lingua franca) অর্থাৎ তরুণেরা এ ভাষায় এখন সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ। আর এটি তো জানা কথা, কাউকে কোনো কিছু শেখাতে হলে প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে তাঁর “স্বাচ্ছন্দ্য”।’