টুটি ফ্রুটির ব্যবসা করে চার বন্ধুর বাজিমাত
আঙিনায় বসে পেঁপের ছাল ছাড়াচ্ছেন জনা বিশেক নারী। কেউ ফালি করে কাটছেন। কেউবা পেঁপের ভেতরে থাকা বীজ সরিয়ে তুলে দিচ্ছেন কিউবিং মেশিনে। স্বয়ংক্রিয় এ যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসছে পেঁপের ছোট ছোট টুকরা। এরপর ব্লানচিং, ধোয়া, সেদ্ধ করা, চিনি ও ফুড গ্রেড কালার মিশিয়ে শুকানোসহ নানা প্রক্রিয়া। সবশেষে প্যাকেটজাতকরণ। যে পণ্যটি তৈরির জন্য এত উদ্যোগ আয়োজন, তার নাম টুটি ফ্রুটি। আন্তর্জাতিক বাজারে এটি এমব্রোসিয়া বা কাসাটা নামেও পরিচিত। বেকারি, আইসক্রিম, বিভিন্ন ডেজার্টসহ নানা খাবারের অন্যতম উপাদান এ টুটি ফ্রুটি।
দীর্ঘ দুই বছর ধরে টুটি ফ্রুটি নিয়ে গবেষণা করছেন দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) চার শিক্ষার্থী—কাওসার আলম, অখিলচন্দ্র সরকার, নবীন মিয়া ও রাশেদুর রহমান। ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড প্রিজারভেশন বিভাগে স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষে পড়ছেন তাঁরা।
বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক মারুফ আহমেদের নির্দেশনায় করোনাকালের শুরুতে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন তাঁরা। এক বছরের গবেষণা শেষে এখন দিনাজপুর সদর উপজেলার উত্তর ভবানীপুর এলাকায় জায়গা ভাড়া নিয়ে কারখানা গড়ে তুলেছেন। তাঁদের উৎপাদিত পণ্য দিনাজপুরসহ বাংলাদেশের প্রায় ৪০টি জেলায় বিক্রি হচ্ছে। শুরুতে সপ্তাহে ১০০-৩০০ কেজি পণ্য বিক্রি হলেও এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩-৪ টনে। সেই সঙ্গে চার বন্ধুর কারখানায় ৩৫ জন নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। চার বন্ধু প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন ‘নভেল ফুড ক্রিয়েশন লিমিটেড’। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) থেকে উৎপাদিত পণ্যের অনুমোদনও পেয়েছেন তাঁরা।
যেভাবে গবেষণাগার থেকে বাজারে এল টুটি ফ্রুটি
দুই বছরে চার বন্ধুকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, জানালেন কাওসার আলম। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরু থেকেই ল্যাবে নানা খাদ্যপণ্য নিয়ে গবেষণা করতেন তাঁরা। কাওসার বলেন, ‘এমনও দিন গেছে, ফজরের আজান দিচ্ছে আর আমরা ল্যাব থেকে বের হচ্ছি। বন্ধুরা যখন আড্ডায়, আমরা তখন ল্যাবে। গত পাঁচ বছর ল্যাব ছিল আমাদের আড্ডার জায়গা।’ খাদ্যপণ্য নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি এ–সংক্রান্ত প্রযুক্তি নিয়েও ভাবতেন তাঁরা। তাই স্থানীয় মেকানিকদের অনেকের কাছেই তাঁরা পরিচিত মুখ।
চার বন্ধু ভাবছিলেন, অনেক রকম খাদ্যপণ্য নিয়েই তো গবেষণা হয়। কিন্তু সেগুলো বাজারে আসে না। গবেষণাগারেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। বাকিদের তাই প্রস্তাব দেন কাওসার, গবেষণাগার থেকে অন্তত দুটি পণ্য বাজারে আনলে কেমন হয়! ২০১৯ সালের জুন মাসে টুটি ফ্রুটি এবং প্রিজারভেটিভবিহীন দই নিয়ে গবেষণা প্রায় শেষ করেন তাঁরা। চার বন্ধু একমত হওয়ার পর সে বছরের শেষে শুরু হয় পথচলা।
বিশ্ববিদ্যালয়–সংলগ্ন শুভ্রা এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নেন তাঁরা। স্থানীয় বাজার থেকে পেঁপে সংগ্রহ করে কাজ শুরু করেন। কিন্তু আট মাসের মাথায় বাসা ছেড়ে দিতে হলো। কারণ, আবাসিক এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা ছিল না। তা ছাড়া প্রচুর পানি খরচ হচ্ছিল। অখিল বলেন, ‘সেই বাসায় কাজ করার সময় একবার হাল ছেড়ে দিলাম। মনে হচ্ছিল হবে না। একবার তো বেখেয়ালিপনায় প্রায় দুই টন পেঁপে নষ্টই হয়ে গেল। চারজন কাজগুলো ভাগ করে নিয়েছিলাম। দেখা গেছে কেউ ল্যাবে, পড়ার টেবিলে, আবার কেউ ব্যস্ত মেকানিকের দোকানে।’
২০২১ সালের জুন মাসে উত্তর ভবানীপুর এলাকায় একটি পরিত্যক্ত গুদামঘরসহ জায়গা ভাড়া নিলেন তাঁরা। এরপর বিদ্যুৎ–সংযোগ নেওয়া, জায়গাটি কারখানার উপযোগী করে তোলা...কত কাজ! নিজেদের জমানো কিছু টাকার সঙ্গে ধারদেনা করে মোট পুঁজি দাঁড়িয়েছিল ৪ লাখ টাকা। যন্ত্রপাতি, ক্রোকারিজ সামগ্রী, আসবাবসহ নানা কিছু কিনতে হয়েছে। এখন পণ্য বিক্রির টাকাসহ নানা ধাপে প্রতিষ্ঠানের পেছনে চার বন্ধুর বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০ লাখ টাকা।
অখিল, নবীন, রাশেদের বাড়ি থেকেও একই কথা—চাকরিতে ঢুকছ কবে? কাওসার ছাড়া বাকি তিনজন অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন কোম্পানি গড়ার কথা। জুবায়ের বলেন, ‘বাড়িতে বাবা কোনোভাবেই মানছেন না।’ তবু চার বন্ধুর এক কথা—চাকরি করব না।
চারজনের এক কথা—চাকরি করব না
বাড়ি থেকে ফোন আসে হররোজ—পড়ালেখা শেষ, এখনো ক্যাম্পাসে কেন? চাকরির প্রস্তুতি তো নিতে হবে। মুঠোফোনে কাওসারকে তাগাদা দেন বাবা। বাবার কাছে আরও কিছুদিন সময় চেয়ে নেন কাওসার। এভাবেই চলছে। অখিল, নবীন, রাশেদের বাড়ি থেকেও একই কথা—চাকরিতে ঢুকছ কবে? কাওসার ছাড়া বাকি তিনজন অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন কোম্পানি গড়ার কথা। জুবায়ের বলেন, ‘বাড়িতে বাবা কোনোভাবেই মানছেন না।’ তবু চার বন্ধুর এক কথা—চাকরি করব না।
কারখানায় পালাক্রমে দুজন করে পাহারা দেন। এই শীতেও তাঁদের বিছানা মেঝেতে। কাওসার জানান, পার্শ্ববর্তী পঞ্চগড় জেলায় বাড়ি হলেও গত সাত মাসের বেশি সময় ধরে বাড়িতে যাওয়া হয়নি। তবে বাবাকে শিগগিরই জানাবেন, নিয়েও আসবেন কারখানায়, জানালেন তিনি।
তরুণ এই উদ্যোক্তাদের মতে—দেশে টুটি ফ্রুটির বড় বাজার আছে। কাঁচামালও পর্যাপ্ত। কিন্তু এখনো বড় বড় বেকারি ও প্রতিষ্ঠান এ পণ্য আমদানি করছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে কাজ করছেন তাঁরা। অনেকে এরই মধ্যে রাজি হয়েছে, তাঁদের কাছ থেকে পণ্য নিয়েছে। রাশেদ বলেন, ‘আমাদের একটা সুবিধা হলো যেহেতু এ বিষয়েই পড়ালেখা করেছি, তাই যথেষ্ট স্বাস্থ্যসম্মত ও অর্গানিকভাবে, সতর্কতার সঙ্গে পণ্যটি উৎপাদন করতে পারছি। তাই শুরু থেকেই সাড়া পেয়েছি। টুটি ফ্রুটি রপ্তানির সম্ভাবনা আছে। কারণ, এটা খাবারের সৌন্দর্য বাড়ায়। তা ছাড়া খাবারের বিষয়ে লোকে আজকাল যথেষ্ট শৌখিন।’
দই ও অন্যান্য
টুটি ফ্রুটির পাশাপাশি দইও বাজারজাত শুরু করেছে নভেল ফুড ক্রিয়েশন লিমিটেড। তাঁদের উৎপাদিত দইয়ের নাম ল্যাকটো। তরুণ এই উদ্যোক্তারা জানালেন—বাজারের সাধারণ দইয়ে ঘন চিনির পরিমাণ বেশি থাকে। স্বাস্থ্যের জন্য যা ক্ষতিকর। তাই প্রিজারভেটিভবিহীন দই তৈরি করেছেন তাঁরা। ইতিমধ্যে দিনাজপুরের অনেকগুলো হোটেল-রেস্তোরাঁয় তাঁদের দই বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া দইয়ের পুষ্টিগুণ নিয়েও চলছে তাঁদের গবেষণা।
আপাতত স্থানীয়ভাবে দুধ সংগ্রহ করে দই তৈরি চলছে। তবে গরুর খামার গড়ার পরিকল্পনা করছেন তাঁরা। আমাদের সঙ্গে আলাপের ফাঁকে এক বাটি দই নিয়ে এলেন জুবায়ের। প্রচলিত দইয়ের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন স্বাদই পাওয়া গেল।
২০১৮ সালে কালো জামের জুস নিয়ে গবেষণা করেছিলেন এই চার বন্ধু। জানালেন, চালকুমড়া থেকে মোরব্বা, আম থেকে ড্রাই ফুড, লিচুর পাল্প সংরক্ষণ এবং টমেটো থেকে জুস তৈরির গবেষণাও করছেন তাঁরা। হাবিপ্রবির শিক্ষার্থী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার থেকে মিলছে সহায়তা। সম্প্রতি উপাচার্য এম কামরুজ্জামান শিক্ষার্থীদের গড়া এ কারখানা পরিদর্শন করে গেছেন। সবকিছু দেখে যথাসম্ভব সহায়তার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি।
শুরু থেকেই এই শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলেন ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড প্রিজারভেশন বিভাগের চেয়ারম্যান মারুফ আহমেদ। ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত গবেষণার জ্ঞান মাঠপর্যায়ে নিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন বলে তিনি খুব খুশি। বললেন, ‘ওরা এখন প্রায় আধ ডজন খাদ্যপণ্য নিয়ে গবেষণা করছে। আন্তর্জাতিক মানের বেশ কয়েকটি জার্নালে ওদের গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে। প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে আমাদের ছেলেদের উদ্যোগ আরও অনেক বড় পরিসরে পৌঁছে যাবে।’