টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চাই তথ্য-উপাত্ত

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো নিয়ে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও), গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজ পর্যালোচনা করতে গিয়ে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) অভিজ্ঞতার আলোকে এটা বুঝতে পেরেছে যে, উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে অধিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মূল কথা হচ্ছে, সকল জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তকরণ। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য প্রয়োজন ভৌগোলিক অবস্থান ও লিঙ্গের ভিত্তিতে বিভাজিত তথ্য-উপাত্ত । তবে আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে শিশু, প্রজননক্ষম নারী, তরুণ ও প্রবীণ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং অরক্ষিত অন্যান্য জনগোষ্ঠীর বিষয়ে অধিকতর তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন।
তথ্যের উৎস:
এসডিজির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধানের নেটওয়ার্ক প্রয়োজনীয় আটটি তথ্য-উপকরণ চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে আদমশুমারি, নাগরিক নিবন্ধন এবং জন্ম মৃত্যু বিষয়ক পরিসংখ্যান (সিআরভিএস) এবং খানা জরিপ হচ্ছে জনসংখ্যাভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ।
জনসংখ্যা ও গৃহগণনা শুমারিই হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন পরিবীক্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস। তবে এসব প্রক্রিয়ায় যেহেতু দীর্ঘ বিরতিতে তথ্য সংগ্রহ করা হয় তাই জনসংখ্যা সম্পর্কিত চলকসমূহের স্বল্পমেয়াদি বা তাৎক্ষণিক পরিবর্তনটা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। সম্ভাব্য একটি সমাধান হিসেবে কেন্দ্রীয় জনসংখ্যা নিবন্ধনের তথ্য নিয়ে জনসংখ্যার আকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও অবস্থান সম্পর্কে হালনাগাদ পরিসংখ্যান এবং জন্ম মৃত্যু, অভিবাসন ও অন্যান্য তথ্য পাওয়া যেতে পারে। তবে এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন বাংলাদেশসহ এশিয়ার অনেক দেশে এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় মোট জন্মের মাত্র ৩৯ শতাংশ নিবন্ধন হয়ে থাকে। এসডিজির লক্ষ্য ১৬.৯ অনুযায়ী সব মানুষের বৈধ পরিচয় অর্জনের জন্য জন্ম নিবন্ধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর এটা মানবাধিকারেরও একটি প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত।
যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের বিভিন্ন দিক পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে জনমিতিক ও স্বাস্থ্য জরিপ (ডিএইচএস) এবং মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নারীস্বাস্থ্যের অবস্থা জানার জন্য ডিএইচএসের ফলাফল থেকে খুব ভালো ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশে ডিএইচএস কেবল বিভাগীয় পর্যায়ের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে থাকে। কিন্তু টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মূল কথা ‘কাউকে পেছনে ফেলে যাওয়া যাবে না’ মানতে গেলে জেলা, উপজেলা, সম্ভব হলে গ্রাম পর্যায়ের তথ্যও প্রয়োজন।
এসডিজির রূপরেখায় যে ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে, তাদের মধ্যে ৪২ টির তথ্য-উপাত্তের উৎসই জাতীয় পর্যায়ে খানা জরিপের ওপর নির্ভরশীল।
সামাজিক এবং স্বাস্থ্য তথ্যে ঘাটতির উদাহরণ:
* বাংলাদেশে জনসংখ্যাবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত সমূহ আদমশুমারি, স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম, জনমিতিক ও স্বাস্থ্য জরিপ (ডিএইচএস), মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে, নারীর প্রতি সহিংসতা ও শ্রমশক্তির ওপর জরিপ প্রভৃতি উৎস থেকে পাওয়া যায়। তবে এসডিজির জনসংখ্যা সম্পর্কিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক পরিবীক্ষণের ক্ষেত্রে অরক্ষিত জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য আরও অধিকতর বিভাজিত তথ্য–উপাত্ত প্রয়োজন। এসব উপাত্ত প্রাপ্তি সাপেক্ষে সকল গোষ্ঠীকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা (এসআরএইচ) প্রদানে এবং নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে।
* যেসব দেশে সব এলাকা নাগরিক নিবন্ধন ব্যবস্থার আওতাভুক্ত নয়, সেখানে জন্ম-মৃত্যু-বিয়ের একটি নমুনা নিবন্ধন চালু করে সেটা পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কিত পারফরম্যান্স মনিটরিং অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি বা পিএমএ ২০২০ জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আওতাধীন বেশ কিছু সূচকে অগ্রগতি পরিবীক্ষণ করা সম্ভব হবে।
* বাংলাদেশে অবিবাহিত কিশোর-কিশোরী ও যুবাদের বয়স এবং লিঙ্গভিত্তিক, প্রজননক্ষমতা, জন্মনিরোধক সামগ্রীর কাঙ্ক্ষিত চাহিদা ও ব্যবহারের হার অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবার বিভাজিত তথ্যের ঘাটতি রয়েছে।
* নারীর ওপর শারীরিক ও যৌন সহিংসতার বিষয়ে বয়স এবং স্থানভিত্তিক পৃথক তথ্যের অভাব রয়েছে, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে।
* ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রায় ১৫ বছরের কম বয়সী এবং ৪৯ বছরের বেশি বয়সী মানুষের চাহিদাগুলোও পর্যবেক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
* মাতৃমৃত্যু, নারীদের সাধারণ অসুখ-বিসুখ, যৌনতাবাহিত বিভিন্ন সংক্রমণ, পেশাভিত্তিক জনগোষ্ঠীর (যেমন চা-শ্রমিক) ক্ষেত্রে পৃথক যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কিত সূচক এবং জরুরি সেবার বিষয়ে বার্ষিক তথ্য-উপাত্ত নেই বললেই চলে।
* বেসরকারি খাত থেকে যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধা রয়েছে।
* সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য খাতের সব তথ্য যাতে একসঙ্গে পেতে পারে, তার উপযোগী একটি কেন্দ্রীয় ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) প্রয়োজন রয়েছে।
তাৎক্ষণিক তথ্য প্রাপ্তি
বর্তমানে যে উপাত্ত বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছে তা তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দীর্ঘ বিরতি বা সময়ক্ষেপণের মাত্রাটা অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ মৃত্যুহারের তথ্যের জন্য জরিপের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে সিআরভিএসের মাধ্যমে সংগ্রহ করা যায়। এ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক তথ্য পাওয়া সম্ভব। তথ্য-উপাত্তের বিভিন্ন উৎসকে সমন্বয়ের মাধ্যমে জনসংখ্যাভিত্তিক হিসাবকে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে মিলিয়ে কর্মসূচি পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে আরও ভালো সমন্বয়ের মাধ্যমে এমআইএস ব্যবস্থাকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে কেন্দ্রীভূত করা হলে জাতীয় স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের অধিকতর সমন্বিত চিত্র মিলবে। বড় পরিসরের তথ্য-উপাত্ত যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মুঠোফোনসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক উৎস থেকে সংগ্রহ করা যায়। তা জনসংখ্যাভিত্তিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী অগ্রগতি সাধন করতে পারে।
বাংলাদেশে পরিসংখ্যান দপ্তরের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্থানীয় পর্যায়ে (ইউনিয়ন-মৌজা) মানচিত্র তৈরির কাজে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) সহায়তা দিচ্ছে। এসব মানচিত্রে গ্রামীণ ও নগর অঞ্চলের সর্বশেষ জনগণনার তথ্য, মৌলিক অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা এবং বিদ্যালয় সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। নিয়মিত বিরতিতে হালনাগাদ করা মানচিত্রগুলো নীতিনির্ধারকদের জন্য প্রান্তিক ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কাছে সেবা পৌঁছানোর জন্য কার্যকর উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
প্রচলিত তথ্য ও তাৎক্ষণিক তথ্যের সমন্বয়
জনগণনায় সংগৃহীত তথ্য প্রশাসনিক নিবন্ধন, খানা জরিপ ও অন্যান্য তথ্যভান্ডারের সঙ্গে সমন্বয় করে নেওয়া প্রয়োজন। তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ভূ-স্থানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। বড় পরিসরের তথ্যগুলো জনগণনা ও জরিপের মতো প্রচলিত বিভিন্ন উৎসের পরিপূরক হতে পারে। তবে নতুন উৎসগুলোর দায়িত্বশীল ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
তথ্য সংগ্রাহক ও ব্যবহারকারীদের মধ্যে বাধা অপসারণ
উন্নয়নশীল অনেক দেশে তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বেশ তৎপরতা শুরু হয়েছে। ২০১০ সালে ইউএনএফপিএর বৈশ্বিক মূল্যায়ন অনুযায়ী, জনগণনার তথ্য সংগ্রহে সহায়তা বাড়ছে। এ বিষয়ে প্রচার কার্যক্রমেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে তা তথ্যের ব্যবহার (বিশেষত নীতিনির্ধারণে) বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ভবিষ্যৎ দিক নির্দেশনা
এসডিজির জন্য তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজনীয়তা এমডিজির চেয়ে অনেক বেশি। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রার সংখ্যা, উদ্দেশ্য ও সূচকগুলোই এর কারণ। ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান আইন অনুযায়ী, সরকারি পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও অনুমোদনের অধিকার বিবিএসকে দেওয়া হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সূচকগুলোকে পরিবীক্ষণের জন্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের লক্ষ্যে পরিসংখ্যান সংস্থাগুলোকে আরও বেশি বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান প্রয়োজন। বিশেষত জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে নিবন্ধনের তথ্য পেতে এটা করা দরকার। তাৎক্ষণিক তথ্য প্রক্রিয়াকরণের লক্ষ্যে নতুন প্রযুক্তিগুলো গ্রহণের ওপর আরও গুরুত্ব দিতে হবে । উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়নকালে উন্মুক্ত তথ্য নীতির মাধ্যমে তথ্য সমন্বয়, সংকলন ও জনসংখ্যাভিত্তিক তথ্যের অধিকতর ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
ইউএনএফপিএর একটি প্রতিবেদন থেকে অনূদিত