ট্যাকা দেন, ভাত খামু!

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

শরীরে কেমন যেন অস্বাভাবিক ক্লান্তি ভর করছে। এমনিতেই পুরো রাস্তা বাসে দাঁড়িয়ে আসতে হয়েছে, তার ওপর ছিল ভাপসা গরম। সকালের ঘুমটাও যেন তখন সুযোগ পেয়ে জেঁকে বসেছিল। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু বাসের ভেতরে মানুষের উত্তাপে এ বৃষ্টিতে শীতলতার কোনো আভাস পাইনি।
সবে সাড়ে আটটা বাজে। ক্লাস শুরু হবে ১০টায়। হাতে আপাতত অনেক সময় আছে। ভাবলাম বাস যেহেতু ক্যাম্পাসে থাকবে, খানিকক্ষণ বসে সময় কাটানো যাবে।
সামনের দিকে সিটে আরামে বসে পড়লাম। কাঁধের ব্যাগটা পাশের সিটে রেখে সমরেশ মজুমদারের গর্ভধারিণী বইটা বের করে পড়া শুরু করলাম।
বাসে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের আরও অনেকেই আছে। সবাই যে যার মতো। কেউ বই পড়ছে, কেউ পত্রিকা, কেউ আবার সিটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আমি আরামেই উপন্যাসটা পড়ছি। এমন সময় পেছন থেকে করুণ কণ্ঠ শুনতে পেলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম বাদামওয়ালা। পেছনে ফিরে দেখি—না, বাদামওয়ালা না। কিন্তু ভিক্ষুক বলেও মনে হচ্ছে না। ছেলেটি একে একে সবার কাছে যাচ্ছে আর তার সকরুণ কণ্ঠে বলছে—‘দুইডা টেকা দেন, আমি ভাত খামু’। কেউ কেউ দুই টাকা দিচ্ছে আবার কেউ ‘নাই’ বলে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এই ফিরিয়ে দেওয়ায় তার কোনো ভাবান্তর নেই। সে তার মতো আবার অপরজনের কাছে হাত পাতছে—‘দুই টেকা দেন, আমি ভাত খামু’।
আমি যেহেতু বাসের একদম সামনে ছিলাম তাই সব শেষে ছেলেটি আমার কাছে এল। ঠিক একইভাবে বলল।
আমি কিশোর ছেলেটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করলাম। সে এখন অন্যপক্ষের করুণার অপেক্ষায় আছে। করুণা বর্ষণ করলেই চলে যাবে অন্য কোনো আরেকজনের কাছে করুণার আশায়। ছেলেটির পরনে হালকা লাল রঙের একটা ময়লা টি-শার্ট আর গোড়ালির ওপর পর্যন্ত ভাঁজ করা জিনসের একটি জীর্ণ ফুল প্যান্ট। পায়ে কোনো জুতা নেই। পায়ের ওপর কাদা-মাটি লেগে আছে। মাথার চুল উষ্কখুষ্ক, ঠোঁটের চামড়া শুকিয়ে গেছে। চেহারার মধ্যে কেমন যেন একটা মলিনতা ফুটে উঠেছে। সেই মলিনতা আরও করুণ মায়ায় পরিণত হচ্ছে যখন সে দুই টাকা করুণা ভিক্ষা চাইছে।
আমি মুখে কিছুটা হাসি এনে বললাম, দুই টাকা দিয়ে কি ভাত পাওয়া যায়?
ছেলেটি সেই করুণ গলাতেই বলল—না, ভাত খাইতে চল্লিশ ট্যাকা লাগে।
তাহলে এভাবে দুই টাকা করে চাচ্ছো কেন?
‘কেউ চল্লিশ ট্যাকা দিবার চায় না, তাই দুই ট্যাকা কইরা চাই। চল্লিশ ট্যাকা জমলে আমি ভাত খামু।’
থাকো কোথায়?
‘ওই নয়াবাজার আছে না? ওই হানে রাস্তায় থাহি।’
মা, বাবা কী করে?
‘বাপ নাই, আমাগো থুইয়া চইল্লা গেছে। আম্মায় বাজার ঝাড়ু দেয়। হেই হানে যহন ট্যাকা পায়, তহন আমরা ভাত রাইন্দা খাই।’
আজ ভাত খেতে পারোনি?
‘কাইলকা মায় ট্যাকা পায় নাই, হের লাইগা কাইল থেইকা ভাত খাই নাই।’
তোমার নাম কী?
‘পলাশ।’
এত সকালে ভাত কোথায় পাবা, চলো আমাদের ক্যানটিনে খিচুড়ি খাওয়াই।
সে অবলীলায় বলে গেল, ‘না, আমি ভাত খামু। খিচুড়ি না।’ পরক্ষণেই কিছুটা উৎসাহ নিয়ে সে বলল, ‘সদরঘাটে একটা হোটেল আছে, ওই হানে ভাত পাওন যায়।’
ছেলেটিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার প্রচণ্ড ভাতের খিদে পেয়েছে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। ঠোঁটের কোণে একটু হাসি এনে তার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি রেখে বললাম, চলো পলাশ, তোমাকে ভাত খাওয়াইতে নিয়ে যাই। লক্ষ করলাম তার চেহারার মাঝে একধরনের উজ্জ্বলতা ফুটে উঠছে। সে এখন অবাক দৃষ্টিতে আমাকে বোঝার চেষ্টা করছে। আমি পরক্ষণেই পলাশের চোখ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে উঠে পড়লাম। বাস থেকে নেমে যাচ্ছি, আমাকে অনুসরণ করে নেমে আসছে পলাশ। বাস থেকে নেমে আসার সময় অনুভব করলাম বাসের সবাই আমাদের দুজনের দিকে গভীর কৌতূহলে তাকিয়ে আছে।
পথে হেঁটে যেতে যেতে চার্লস ডিকেন্সের সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে হতেই ঠোঁটের কোণে রহস্যময় একটা হাসি খেলে গেল—
‘পৃথিবীর এক প্রান্তে প্রচুর খাদ্য কিন্তু কোনো ক্ষুধা নেই, অন্য প্রান্তে প্রচুর ক্ষুধা কিন্তু কোনো খাদ্য নেই।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা