ট্রাকের রেস, রেসের ট্রাক!
গ্যালারি থেকে টি-ওয়ান প্রাইমা ট্রাকগুলোকে লাগছিল খেলনার মতো। রেস শুরু হলো। আক্ষরিক অর্থেই বাহনগুলো এগোতে লাগল ‘গুটি গুটি পায়ে’। এরা যেন একই ক্লাসের সতীর্থ এবং যুক্তি-বুদ্ধি করে এসেছে, ‘আজ আমরা কেউই ফার্স্ট হব না।’
১৯ মার্চ, সূর্য ঠিক মাথার ওপরে। ভারতের উত্তর প্রদেশের গ্রেটার নয়ডার বুধ ইন্টারন্যাশনাল সার্কিটে এক কথায় এলাহী আয়োজন। ফলে ট্রাকগুলোর গতিবিধি দেখে মনে হচ্ছিল, ‘যত গর্জাচ্ছে, তত কি দৌড়াবে?’ বাংলাদেশ থেকে আসা একজন তো ফোড়নই কেটে বসলেন, ‘দূর, এরচেয়ে ঢাকার ট্রাক বেশি জোরে ছোটে।’ কথাটা মাটিতে পড়তে না পড়তেই ট্রাকগুলো যেন ‘গোঁ গোঁ’ করে উঠল। চোখের পলকে বেড়ে গেল গতি। এবার মনে হলো, একেকটা বুনো ষাঁড় ছুটে যাচ্ছে! চার-পাঁচটা চক্কর খাওয়ার পর ‘বুনো ষাঁড়’গুলো ছুটতে লাগল ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার বেগে। আমরা স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, ‘হুঁ-হুঁ বাবা, একেই বলে রেস!’
তিন বছর ধরে ভারতে ট্রাক রেসের আয়োজন করছে টাটা মোটরস। ১৯ মার্চ বসেছিল এর চতুর্থ আসর। টি-ওয়ান প্রাইমা ট্রাক রেসিং চ্যাম্পিয়নশিপ নামের এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এসেছিলেন ১২ জন আন্তর্জাতিক ট্রাক রেসার। ৬টি দলে ১২টি ট্রাক নিয়ে ছুটেছেন তাঁরা। এই ৬টি দলের মধ্যে একটি ছিল বিশ্বব্যাপী টাটা মোটরসের পরিবেশক ও ডিলারদের প্রতিনিধিত্বকারী দল ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড রেসিং’। এই দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেছে বাংলাদেশের নিটল-নিলয় গ্রুপ। এ ছাড়া ভারতীয় ট্রাকচালকেরাও প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন আলাদা একটা গ্রুপে।
ট্রাক রেস শুরুর আগে ‘অ্যাপিটাইজার’ হিসেবে গ্যালারির দর্শকের জন্য ছিল চিয়ার লিডারদের নাচ, তরুণ ভারতীয় শিল্পীদের গান। বুধ ইন্টারন্যাশনাল সার্কিটটা আসলে বানানো হয়েছিল ফরমুলা ওয়ান রেসের জন্য। বছর তিনেক চলার পর এখানে আর রেস হয়নি। ফলে গাড়ি দৌড়ের জন্য যা যা দরকার, তার সবই বর্তমান। ঝাঁ–চকচকে ট্র্যাক, অতিথিদের জন্য হসপিটালিটি বক্স আর বর্ণিল গ্যালারি। আর এই গ্যালারিও ছিল দর্শকে মুখরিত। ভারতীয় চালকদের প্রথম রেসের পর দর্শক আরও রোমাঞ্চিত। অধীর আগ্রহে সবাই তাকিয়ে আছে ট্র্যাকের পাশে দাঁড় করানো একটা লম্বা ট্রাকের দিকে। এই ট্রাকটা দিয়েই বানানো হয়েছিল মূল মঞ্চ। দুপুরের রোদে চারপাশ ঝলমলে। আরও আলো ছড়ালেন বলিউড তারকা অক্ষয় কুমার। টাটা মোটরসের এই শুভেচ্ছাদূত যখন মঞ্চে উঠলেন, তখন মনে হলো আরেক রেস শুরু হয়ে গেছে! এই রেস একটা সেলফি তোলার। দর্শক তাঁকে গ্যালারি থেকে দেখেই আশ মিটিয়েছে। তবে কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন কেবল বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা টাটা মোটরসের পরিবেশক, ডিলার ও শুভানুধ্যায়ীরাই। অক্ষয় তাঁর স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে অনুভূতির কথা জানালেন, ‘ভারতে নিয়মিত ট্রাক রেস হচ্ছে, এটা দারুণ রোমাঞ্চকর!’
রোমাঞ্চকর এই রেসের আয়োজনের উদ্দেশ্য কী? রেস শুরুর আগে প্রশ্নটা করেছিলাম টাটা মোটরসের কমার্শিয়াল ভেহিক্যাল বিভাগের নির্বাহী পরিচালক রবি পিশারোদির কাছে। রবি বললেন, ‘সামাজিকভাবে ট্রাকচালকদের সম্মানিত করাই আমাদের উদ্দেশ্য। এ ছাড়া আমরা চাই ভারতে আন্তর্জাতিক মানের ট্রাক রেস হোক। এই উপমহাদেশে আমরাই এটা শুরু করেছি। এটা নিয়মিত হলে এখান থেকেই আন্তর্জাতিক মানের ট্রাক রেসার বেরিয়ে আসবেন।’

ইউরোপ-আমেরিকায় অনেক আগে থেকেই ট্রাক রেস হয়। ভারতে নতুন চালু হওয়া এই আয়োজনে তাই সর্বদা পাদপ্রদীপের আলোয় ছিলেন বারোজন আন্তর্জাতিক রেসার। তাঁদের একজন ইংল্যান্ডের অ্যাডাম বিন্ট। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ নামডাক তাঁর। ইংল্যান্ডের ট্রাক রেসে ডিভিশন টু চ্যাম্পিয়ন। তৃতীয়বারের মতো এসেছেন এই প্রতিযোগিতায়। কেমন লাগছে এখানে এসে?
এখানকার রেসও কি ইউরোপের রেসের মতো ‘ফাটাফাটি’? রেসের পোশাক গায়ে চাপাতে চাপাতে অ্যাডাম বললেন, ‘সবে তো শুরু হয়েছে, প্রতিযোগী কম; তবে আয়োজনে কোনো ঘাটতি নেই। দারুণ পরিবেশ। আর রেস শুরু হলে পৃথিবীর সব ট্র্যাক একই রকম লাগে।’
প্রতিযোগী কম—এ বিষয়টা ভালোভাবেই মাথায় রেখেছে টাটা মোটরস ও মাদ্রাজ মোটর স্পোর্টস ক্লাব। ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়েছে এরই মধ্যে। ভারতীয় ট্রাকচালকদের রেসের জন্য প্রস্তুত করতে অনুশীলনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ব্রিটিশ ট্রাক রেসিং অ্যাসোসিয়েশন। আর ভারতের হয়ে চালকদের সবক দিচ্ছেন ফরমুলা ওয়ানের ভারতীয় রেসার করুণ চান্দোক। ট্রাক রেসে ভারতের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখছেন ৩৩ বছর বয়সী এই রেসার, ‘শুরু তো হয়েছে, এটা চলতে থাকবে। এই প্রতিযোগিতার আগে চেন্নাই ও দিল্লিতে চালকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি আমরা। অনেকটা রিয়েলিটি শোর মতো ভবিষ্যতের তারকা চালকদের তুলে আনা হয়েছে। খুব বেশি দেরি নেই, যেদিন ভারতের চালকেরাও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতা করবেন।’

বাংলাদেশের কোনো চালক এই প্রতিযোগিতায় নেই কেন? অধিকার নিয়েই প্রশ্নটা করেছিলাম টাটা মোটরসের কান্ট্রি হেড (বাংলাদেশ) জিতেন্দ্র বাহাদুরের কাছে। কারণ, তিনিই জানিয়েছিলেন, সারা বিশ্বের মধ্যে টাটা মোটরসের সবচেয়ে বড় বাজার বাংলাদেশে। একই প্রশ্ন করলাম টাটা মোটরসের কমার্শিয়াল ভেহিক্যাল বিভাগের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসের প্রধান রুদ্ররূপ মৈত্রের কাছে। জিতেন্দ্র ও রুদ্ররূপের উত্তর মিলে গেল, ‘বাংলাদেশের চালকদের আমন্ত্রণ তো জানানোই যায়। তবে আমাদের ইচ্ছা, বাংলাদেশেও এমন ট্রাক রেসের আয়োজন করা হবে। এটা খুব সম্ভব। কারণ, বাংলাদেশে আমাদের বিশাল বাজার। আর খুঁজলে নিশ্চয়ই অনেক দক্ষ চালকও পাব।’
প্রতিযোগিতার চালকদের কাছে ফিরে আসি। রেসের আগে ঘুরে ঘুরে প্রতিটা দেখছি। একটা ট্রাকের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হলো। কারণ, এই ট্রাকের চালক একজন নারী। ভারতে আয়োজিত ট্রাক রেসে এবারই প্রথম একজন নারী নাম লিখিয়েছেন। জার্মানির এই রেসারের নাম স্টেফানি হাম। দলের অন্যদের নিয়ে ট্রাকের দেখভাল করছিলেন। সামনে গিয়ে বললাম, ‘কথা বলতে চাই। সাংবাদিক।’
‘এক মিনিট’ বলে রেসের পোশাকটা পরে এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘অন্যরা তোমার সঙ্গে পারবে তো?’ স্টেফানি বেশ আত্মবিশ্বাসী, ‘এই প্রতিযোগিতায় আমিই প্রথম নারী চালক। রোমাঞ্চিত বোধ করছি। হ্যাঁ, অন্যদের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছি। দেখা যাক কী হয়।’

শেষমেশ অবশ্য রেসের মাঠে প্রথম হলেন চেক প্রজাতন্ত্রের ডেভিড ভারসেকি। আর ভারতীয় চালকদের দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন উত্তর প্রদেশের পিতাম্বর। ২৯ বছর বয়সী এই চালকের এটাই ছিল প্রথম পেশাদারি রেস! বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান নিটল-নিলয় মোটরসের দল ওয়ান ওয়ার্ল্ড রেসিং ভালো না করলেও আবদুল মাতলুব আহমাদ বেশ খুশি। নিটল-নিলয় মোটরসের চেয়ারম্যান মধ্যাহ্নভোজের সময় বলছিলেন, ‘বাংলাদেশে আমরা খুব ভালো করছি। বড় এই আসরে আমাদের প্রতিষ্ঠানও পেয়েছে যথাযোগ্য মর্যাদা। ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও এমন আয়োজন করতে পারলে ভালো লাগবে।’
দর্শকের জন্য আরও ভালো লাগার পরিবেশ তৈরি করে দিলেন ভারতের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী কেকে। রেসের মাঝখানে আর শেষে মুগ্ধ করলেন তাঁর জনপ্রিয় গানগুলো শুনিয়ে। সবশেষে গাড়িতে চেপে বসেছি আমরা। গ্রেটার নয়ডার হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে গাড়ি। রাস্তার দুপাশের দৃশ্য পেছনে পড়ে যাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। তারপরও মনে হচ্ছে, গাড়ির গতি এত মন্থর কেন? রেসের ঘোর বলে কথা!