তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায় এক প্রহর

ঠিক ১৫ বছর পর সেখানে যাওয়া। প্রথম পা রেখেছিলাম শহীদ তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায়। তারপর তিতুমীরের জন্মভিটায়। পরিবর্তন এটুকুই চোখে পড়ল, সেবার এসে এখানে একটি স্মৃতিস্মারক দেখেছিলাম, এবার সেটি নেই। সেই স্মৃতিস্মারক ভেঙে এখন নতুন করে তৈরি হচ্ছে স্মৃতিস্মারক, সেই সঙ্গে একটি সংগ্রহশালা।
বাঁশের কেল্লা এখনো এক স্মৃতি। সে স্মৃতি উঁকি মারছে নারকেলবাড়িয়ায়; যে গ্রামে তিতুমীর বাঁশ দিয়ে তৈরি করেছিলেন কেল্লা, যেখান থেকে ব্রিটিশ আর জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য দুর্গ গড়েছিলেন তিনি। যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছিলেন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার হাবড়া-মছলন্দপুর-হাকিমপুর সড়কের টালি কারখানা মোড় হয়ে আমরা সোজা এলাম তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধস্থলে। কিছু নেই, খোলা মাঠ। পাশে একটি পুকুর। যে পুকুরে সেদিন তিতুমীরের অনুচরদের হত্যা করে ফেলে দিয়েছিল ব্রিটিশ সেনারা।
এই ঐতিহাসিক যুদ্ধস্থলকে মানুষের মনে গেঁথে রাখার জন্য ১৯৭২ সালের ২ ডিসেম্বর এখানে তৈরি করা হয়েছিল একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ বা স্মৃতিস্মারক। এখন সেটি আর নেই। এটি ভেঙেই নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে স্মৃতিস্মারক। সেই সঙ্গে তৈরি করা হচ্ছে ছোট একটি সংগ্রহশালাও।
স্মৃতিস্মারকের নির্মাণস্থলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সিরাজুল মণ্ডল বললেন, এই যে স্মৃতি স্মারক দেখছেন, এর পাশেই ছিল সেদিনকার সেই ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লা।
বাঁশের কেল্লা থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে তিতুমীরের জন্মভিটা হায়দারপুর। সেখানে চলে এলাম। বাড়ি পৌঁছলাম গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে। বাড়িতে অতীতের তেমন কিছুই চোখে পড়ল না, সব স্মৃতি মুছে গেছে। বাড়ির কবরস্থানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি স্মৃতিস্মারক। সে স্মৃতিস্মারকই জানান দিচ্ছে, এই হায়দারপুর গ্রামেই জন্মেছিলেন ব্রিটিশ আর জমিদারবিরোধী আন্দোলনের মহান বীর তিতুমীর। আর আছে তিতুমীরের বাড়ির প্রবেশদ্বার। তা-ও অতীতকে বাঁচিয়ে রাখতে বাড়ির সেই প্রবেশদ্বারকে সামান্য সংস্কার করা হয়েছে। এখনো দেখা যায় সেই প্রবেশদ্বারে পাতলা ও ছোট্ট ইটের গাঁথুনি। আর জন্মভিটে? নেই সেই তিতুমীরের পুরোনো বসতবাড়ি। সেখানে তিতুমীরের বংশধরেরা তৈরি করেছেন নতুন বাড়ি।
তিতুমীরের ষষ্ঠ বংশধর মদত আলী বলছিলেন, ‘তিতুমীরের বংশধরেরা এখন ছড়িয়ে আছেন দেশ-বিদেশে। বাংলাদেশের খুলনার সেনহাটি, ইরান, পাকিস্তানের করাচি, ভারতের নাগপুর, লক্ষ্ণৌ আর পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার টাকি, মির্জাপুর আর চারঘাটে।’
ইতিহাস বলছে, তিতুমীরের আসল নাম ছিল মীর নিসার আলী। জন্ম ১৭৮২ সালে। কারও কারও মতে ১৭৭২। এলাকার দরিদ্র চাষি ও তাঁতি সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁর অনুসারী হয়ে উঠেছিলেন। গর্জে উঠেছিলেন জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। ইংরেজ শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য নারকেলবাড়িয়া গ্রামে তৈরি করেছিলেন বাঁশের কেল্লা। তখন নারকেলবাড়িয়ায় পাওয়া যেত প্রচুর বাঁশ। কেল্লা নির্মাণ করে তিতুমীর সেখানে তাঁর ৫০০ অনুচর নিয়ে বসবাস শুরু করেন।
১৮৩১ সালের ১৫ নভেম্বর। কলকাতা থেকে লড়তে আসে ইংরেজ সেনাদল। সেনাবাহিনীর কর্নেল বাঁশের কেল্লার প্রবেশদ্বারে এসে তাঁর তরবারির মাথায় একটি পরোয়ানা ঝুলিয়ে উচ্চ স্বরে বলতে থাকেন, গভর্নর জেনারেল আপনাকে সদলবলে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিয়েছেন। আপনি কি স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হবেন? খেপে ওঠেন তিতুমীর। শুরু করেন ইংরেজ প্রতিরোধ। ইংরেজ সেনারা ঘিরে ফেলে বাঁশের কেল্লা। কেল্লার সামনে স্থাপন করা হয় ব্রিটিশ সেনাদের আনা দুটি কামান। শুরু হয় যুদ্ধ। সে যুদ্ধেই আগুনে পুড়ে বাঁশের কেল্লায় সাঙ্গ হয় তাঁর জীবন। আজ সেই বাঁশের কেল্লা এক ইতিহাস।
তিতুমীরের আত্মত্যাগের স্মৃতি রোমন্থন করে ফিরলাম সেদিন। ফেরার পথে চোখে ভাসছিল তিতুমীরের বাড়ির সামনের স্মৃতিস্মারকের গায়ে শ্বেতপাথরে লেখা সেই কথাগুলো, ‘এখানেই জন্মেছিলেন বীর তিতুমীর। লড়েছিলেন বাঁশের কেল্লায়। উৎসর্গ করেছিলেন নিজের জীবন।’