তিরন্দাজ মেয়েটি

মাথুই প্রু মারমা
মাথুই প্রু মারমা

বান্দরবানের রোয়াংছড়ি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ত মেয়েটি। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট মাথুই প্রু মারমা।
২০০৮ সাল। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন তখন মাথুই প্রু। সে সময় আনসার একাডেমির একটি বাছাই-প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে প্রথম শুনেছিলেন আর্চারির নাম। বাঘমারা পূর্বপাড়া গ্রামের মাথুই প্রু মারমা তখনো জানতেন না, তির-ধনুকের এই খেলাই তাঁর জীবন বদলে দেবে!
‘প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে সুযোগ পেলাম বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। ‘জীবনে এই খেলার নামও শুনিনি, তার ওপর বড় ভাই-আপাদের খেলা দেখে ভয় হচ্ছিল। ভাবছিলাম, আমি কি পারব?’ মাথুই প্রু পেরেছেন। বাংলাদেশের নারী তিরন্দাজদের মধ্যে এখন প্রথম সারিতে আছে তাঁর নাম। ‘আমার ভাগ্য খুব ভালো। জাতীয় পর্যায়ে খেলার আগেই আমি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। সাফ গেমসে দলীয় ও একক—দুই বিভাগেই ব্রোঞ্জ পেয়েছিলাম। এ ছাড়া আরও কয়েকটি প্রতিযোগিতায় পদক জিতেছি। থাইল্যান্ড আর চীনে খেলতে গিয়েছিলাম। সেখানে পুরস্কার না জিতলেও আমার স্কোর মোটামুটি ভালোই ছিল। এ ছাড়া জাতীয় পর্যায়ে আমি সেরা আর্চারের পুরস্কার পেয়েছি।’
মাথুই প্রু মারমার সফলতা শুধু পুরস্কারপ্রাপ্তির সংখ্যা দিয়ে বিচার করা কঠিন। ‘মেয়েদের আবার খেলাধুলা কিসের?’ অহরহই যাঁকে এমন কথা শুনতে হয়, খেলাটা তাঁর কাছে শুধু খেলা নয়, একরকম যুদ্ধও। বলছিলেন, ‘আমাদের এলাকায় আর কেউই খেলাধুলায় এত দূর আসতে পারেনি। শুরু আর্চারি কেন, কোনো খেলাতেই না। তাই আর্চারি শুরু করার পর আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী কেউই খুব একটা ভালো চোখে দেখেননি। একমাত্র মা আর বাবাই সব সময় আমাকে সমর্থন দিয়েছেন। আমি মানুষজনের কথায় কান দিইনি। বাবা-মা সঙ্গে আছেন, তাতেই চলবে।’ বোঝা গেল, বাবা উশুই প্রু মারমা আর মা মেনু প্রু মারমাও তাঁর সাফল্যের অংশীদার। মাথুইরা চার বোন এক ভাই। সবার ছোট বলেই হয়তো তাঁর প্রতি মা-বাবার আদরটা অন্য রকম। এই আদরের টানেই প্রথমে বিকেএসপির শৃঙ্খল জীবন মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে। ছবির মতো সুন্দর বান্দরবান শহরের প্রতিও একটা টান তো আছেই। ‘খুব খারাপ লাগত। ইচ্ছা করত সব ছেড়েছুড়ে বাড়ি চলে যাই,’ বলছিলেন মাথুই।
২০০৯ সালে আনসার বাহিনীতে চাকরি নিশ্চিত হয়েছে। এখন তির-ধনুকের সঙ্গেই তাঁর সময় কাটে। এমনটা তাঁর সুদূর কল্পনায়ও ছিল না, সে কথা আগেই জানা হয়েছে। রোয়াংছড়ি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের মেয়েটি তাহলে বড় হয়ে কী করার স্বপ্ন দেখতেন, জানতে চাই। ‘আমাদের গ্রামে স্যাটেলাইট ছিল না। বিটিভিতে মাঝেমধ্যে সাঁতার প্রতিযোগিতা দেখতাম। তখন মনে হতো, যদি এই সুইমিং পুলের পানিতে নামতে পারতাম।’ সাঁতারু হওয়ার স্বপ্ন তাঁর পূরণ হয়নি। তাতে কী? ‘নতুন স্বপ্ন’ পূরণে তিনি আটঘাট বেঁধে নেমেছেন। ‘সামনে বেশ কিছু প্রতিযোগিতা আছে। তাইওয়ানে একটা চ্যাম্পিয়নশিপ হওয়ার কথা। কোরিয়ায়ও একটা প্রতিযোগিতায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করব। আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম অর্জন করতে চাই।’