তুমি আমার পাশে বন্ধু হে...
>

এই প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে আমরা খোঁজ নিয়েছি দেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। তুলে আনতে চেষ্টা করেছি বন্ধুদের ‘পাশে থাকার গল্প’। এমন অজস্র নিদর্শন নিশ্চয়ই সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। অল্প কয়েকটি নিদর্শন তুলে ধরে আজ বন্ধু দিবসে আমরা বন্ধুত্বের জয়গান গাইতে চাই
বিপদেই বন্ধুর পরিচয়—এ কথা জানতে ঈশপের গল্পে চোখ বোলাতে হয় না। আশপাশে তাকালেই এমন অনেক উদাহরণ চোখে পড়ে। এই প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে আমরা খোঁজ নিয়েছি দেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। তুলে আনতে চেষ্টা করেছি বন্ধুদের ‘পাশে থাকার গল্প’। এমন অজস্র নিদর্শন নিশ্চয়ই সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। তার অল্প কয়েকটি নিদর্শন তুলে ধরে আজ বন্ধু দিবসে আমরা বন্ধুত্বের জয়গান গাইতে চাই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্প ও প্রান্ত (নাম প্রকাশ করতে চান না বলে দুজনেরই ছদ্মনাম ব্যবহার করা হলো)। একই বিভাগে পড়েন। প্রান্তর বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে চাকরি হারালেন। এতে অসহায় হয়ে পরে পুরো পরিবার। বাসা থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে কয়েকটি টিউশনি শুরু করেন প্রান্ত। তাতে নিজের খরচটা চলে বটে; কিন্তু বাবার চিকিৎসা আর পরিবারের অন্য সব খরচের কথা ভেবে তিনি মুষড়ে পড়েন। সে সময় প্রান্তের পাশে এসে দাঁড়ান পুষ্প। কীভাবে? প্রান্ত বলছিলেন, ‘পুষ্প প্রতি মাসে ওর বাসা থেকে নেওয়া খরচের টাকা থেকে একটা বড় অংশ আমাকে দিত। প্রথমে টাকা নিতে খুব দ্বিধা কাজ করছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল যে ওই মুহূর্তে এটা ছাড়া আমার অন্য কোনো উপায়ও ছিল না। আর পুষ্প এমনভাবে বলল যে না বলতে পারিনি।’ অন্যদিকে পুষ্প অবশ্য এ নিয়ে কোনো কথা বলতেই খুব একটা আগ্রহী নন। তাঁর বক্তব্য, ‘বন্ধু বিপদে পড়েছে। সাহায্য করেছি। এটা নিয়ে আবার বলার কী আছে!’
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের নাজমুল রিফাত আর সৌভিত চাকমার গল্পটা না বললেই নয়। দুজনের বন্ধুত্বের বয়স তখনো এক বছরও হয়নি। কিন্তু বন্ধু হওয়ার জন্য বুঝি বহুদিন লাগে? নেত্রকোনার ছেলে নাজমুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাঁটাচলা করতে চিকিৎসকের বারণ। কিন্তু সবেই তো ভর্তি হয়েছেন। ক্লাস কি থেমে থাকবে? মুঠোফোনে নাজমুল বলছিলেন, ‘ ক্লাসে নিয়ে যেতে হলে চলে আসত বন্ধুরা। বিশেষ করে সৌভিত চাকমা। প্রতিদিন সে আমাকে কাঁধে করে ক্লাসে আনা-নেওয়া করত।’ দুই বন্ধুর গল্প এখানেই শেষ নয়। নাজমুলের ইচ্ছা ছিল গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। একসময় ভর্তির সুযোগও পেয়ে গেলেন। কিন্তু তত দিনে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে জুটে গেছে সৌভিতসহ বেশ কয়েকজন বন্ধু। ‘সত্যি বলতে ওরা আমাকে ছাড়তে চাইছিল না। সবাই বলল “ওখানে গেলে একা হয়ে যাবি।” আমিও বন্ধুদের টানেই আর সিলেট ছাড়তে পারিনি।’
অসুস্থ বন্ধুকে সুস্থ করতে অর্থ সংগ্রহের জন্য দলেবলে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঘটনা প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে। তেজগাঁও কলেজের ফিন্যান্স বিভাগের সনজিত চন্দ্র। স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন বিদেশের কোনো বিশেষায়িত হাসপাতালে যেতে। তাঁকে নেওয়া হয় ভারতের ভেলোরের একটি হাসপাতালে। সেখানে জানানো হয়, সনজিতের হৃৎপিণ্ডের পাশে জটিল টিউমার রয়েছে। দ্রুত অস্ত্রোপচার করতে হবে। তবু বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু চিকিৎসার জন্য যে খরচ দরকার ছিল তা সনজিতের একমাত্র ভাইয়ের পক্ষে জোগানো অসম্ভব। তাই বলে কি সনজিতের চিকিৎসা হবে না? এগিয়ে এলেন বন্ধুরা। সনজিতের বন্ধু সৌমিত্র দত্ত বলছিলেন, ‘আমরা নানাভাবে টাকা জোগাড় করা শুরু করি। টাকার জন্য রাস্তায়ও নেমেছি। দিনের পর দিন সবাই মিলে ফার্মগেট ফুটওভার ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষের কাছে সাহায্য চেয়েছি।’ এই দলের ভূদেব টমাস, রাজন, হাবিবা, ভাস্কর, সোনিয়া—সবাই প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করেছে। তা দিয়েই শুরু হয়েছিল চিকিৎসা। কিন্তু বন্ধুদের দলে আর ফিরে আসতে পারেননি সনজিত চন্দ্র। তাতে কি? নিজের সাধ্যের শেষটুকু দিয়ে হলেও পাশে দাঁড়ানোই তো প্রকৃত বন্ধুর ধর্ম।
১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় হামলায় নিহত ফারাজ আইয়াজ হোসেনের কথাই ধরুন। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এই তরুণ রেখে গেছেন বন্ধুত্বের অনুকরণীয় এক দৃষ্টান্ত। দুই বন্ধু অবিন্তা কবীর ও তারিশি জৈনর সঙ্গে তিনি দেখা করতে গিয়েছিলেন গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয়। সে দিনই জঙ্গিরা সেখানে আক্রমণ করে বসে। জিম্মি করে সেখানে উপস্থিত লোকজনেকে। জঙ্গিরা ফারাজকে মুক্তিও দিয়েছিল। চলে যেতে বলেছিল। মুক্তি পাওয়া অন্য বাংলাদেশিরা সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ফারাজকে তাঁদের সঙ্গে যেতে বলে। কিন্তু তিনি দুই বন্ধুকে বিপদে ফেলে সেখান থেকে চলে যেতে রাজি নন। শেষে জীবন দিয়েই ফারাজ আইয়াজ হোসেন ‘বন্ধু’ শব্দটিকে মহিমান্বিত করে গেছেন।