বডিবিল্ডার মাকসুদা আক্তার
‘তুমি মঞ্চে উঠবে? ফেসবুকে তোমাকে নিয়ে ট্রল হবে’
২০২০ সালে জাতীয় শরীরগঠনে চ্যাম্পিয়ন আর ২০২১-এ বাংলাদেশ গেমসে সোনা। এবার তার সঙ্গে যুক্ত হলো আন্তর্জাতিক পদক। ৫ ডিসেম্বর মুম্বাইয়ে অ্যামেচার অলিম্পিয়া ইন্ডিয়া বডিবিল্ডিংয়ে উইমেন ফিজিক ক্যাটাগরিতে তৃতীয় রানারআপ হয়েছেন মাকসুদা আক্তার। আন্তর্জাতিক অভিষেকেই পদক জেতার পর প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে শোনালেন ক্যারিয়ার নিয়ে স্বপ্ন ও উঠে আসার গল্প।
প্রশ্ন :
দেশের প্রথম নারী বডিবিল্ডার হিসেবে আন্তর্জাতিক শরীরগঠন প্রতিযোগিতায় পদক। স্বপ্নের পথে হাঁটা তো শুরু হয়ে গেল...।
আমার বডিবিল্ডিংয়ের জগতে পথচলা বছর তিনেকের মাত্র। সেই হিসেবে শুরুতেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্রোঞ্জ জিতেছি বলে ভালো লাগছে। ওখানে আন্তর্জাতিক বডিবিল্ডারদের রুটিন, কীভাবে তারা পারফর্ম করে, কীভাবে নিজেদের যত্ন নেয়, ওদের জীবনযাপন, অভিজ্ঞতা জেনেছি।
ওখানে এমন অনেক বডিবিল্ডার ছিল, যারা ১৭-১৮ বছর ধরে প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। শুরুতে ভয় হচ্ছিল, কিছু করে দেখাতে পারব কি না। আবার দিন শেষে চিন্তা করেছিলাম যে আমার যতটুকু প্রস্তুতি আছে, সেটা নিয়ে সেরাটাই দেওয়ার চেষ্টা করব। শেষ পর্যন্ত পেরেছি।
প্রশ্ন :
‘ট্যাবু ভাঙতে লড়তে চাই’—কথাটি প্রায়ই বলেন। মেয়েদের বডিবিল্ডিংয়ের বেলায় এই ট্যাবু কতটুকু ভাঙতে পেরেছেন?
প্রথমত বলব খেলাধুলায় কোনো লিঙ্গবৈষম্য নেই। একজন অ্যাথলেট হিসেবে ক্রিকেট, ফুটবল, বডিবিল্ডিং—যেকোনো কিছুতেই অংশ নিতে পারি। যদি খেলোয়াড়ের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাহলে একজন ছেলে যেভাবে অংশ নিচ্ছে, একজন মেয়েও সেভাবে নিতে পারে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করলেও মেয়েরা উৎসাহ পাচ্ছে। আমার মনে হয়, অচলায়তন ভাঙতে কাজ শুরু করেছি।
প্রশ্ন :
বাংলাদেশ বডিবিল্ডিং ফেডারেশন কেমন সহযোগিতা করে?
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মেয়েদের বডিবিল্ডিং শুরু করাটাই কঠিন ব্যাপার। ২০১৯ সাল থেকে শুরু হয়েছে এটা। ওরা উদ্যোগ নিয়েছে বলেই বের হয়ে এসেছি। বাংলাদেশের মতো দেশে মেয়েদের মঞ্চে তুলে পারফর্ম করানো চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ উতরাতে পেরেছে ফেডারেশন।
প্রশ্ন :
পরিবার থেকে কি কোনো বাধা এসেছে?
পরিবার থেকে শুরুতে বাধা ছিল। ওদের বুঝিয়েছি, আসলেই আমি কী করতে চাই। আমার বড় ভাই নাসিমুল হক ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী সদস্য। ভাইয়ার জিম আছে। উনি বাসায় বুঝিয়েছেন। বাড়ি থেকে এখন অনেক উৎসাহ দেওয়া হয়।
প্রশ্ন :
মেয়েদের থেকে কেমন সাড়া পান?
এখন অনেক মেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা বডিবিল্ডিংয়ে আসতে চায়। আসলে পরিবার–সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ানো অনেক বড় ব্যাপার। যারা এখানে আসতে চায়, তাদের প্রতি আমার বার্তা হচ্ছে, নিজের যদি যোগ্যতা থাকে, তাহলে সামনে এগিয়ে যাওয়া সমস্যা নয়। মানুষ কী বলবে, মানুষ কী ভাববে, সেটা নিয়ে বসে থাকার দরকার নেই।
প্রশ্ন :
শুরুতে কি বডিবিল্ডিং করতে ভয় পেতেন?
ভয় পাইনি। তবে শুরুতে অনেকে বলত, তুমি মঞ্চে উঠবে? ফেসবুকে তোমাকে নিয়ে ট্রল হবে। কিন্তু দিন শেষে চিন্তা করেছি, আমি যদি এগিয়ে না আসি, তাহলে এত দিনের কষ্ট মাটি হবে। আসলে আমি একটা মঞ্চ চেয়েছি, যেখানে নিজের প্রতিভা দেখাতে পারব। দিনকে দিন কাজ করতে করতে সাহসটাও বেড়েছে আমার।
প্রশ্ন :
এই সাহস কোথা থেকে পেয়েছেন?
প্রথমত বলব আমি একজন অ্যাথলেট। বাইরের দেশের বডিবিল্ডারদের দেখেছি, ওরা কিন্তু চিন্তা করে না যে সে একজন ছেলে কিংবা মেয়ে। ওরা যখন মঞ্চে পারফর্ম করে, তখন তারা শুধুই একজন অ্যাথলেট। দিন শেষে এটাই আমার প্রেরণা, সাহসের জায়গা।
প্রশ্ন :
বাংলাদেশে নারী বডিবিল্ডার কি উঠে আসছেন?
অনেক নারী বডিবিল্ডার আছে দেশে। আমার জেলা চট্টগ্রামে অনেক ছোট জিমে গিয়েছি, সেখানে অনেক সম্ভাবনা দেখেছি। শুধু তাদের ভালোভাবে প্রশিক্ষণ ও স্কুলিং দরকার। অনেক গ্রামাঞ্চলের জিমে গিয়ে দেখেছি, বোরকা পরে মেয়েরা আসে। ওরা বডিবিল্ডিংয়ে আসতে চায়। কিন্তু আসতে পারবে কি না, সেই আত্মবিশ্বাসের জায়গাটা ওদের নেই। সুযোগটা করে দিতে হবে আমাদেরই। মেয়েদের চমৎকার একটা প্ল্যাটফর্ম দেওয়া আমাদেরই দায়িত্ব।
প্রশ্ন :
ছোটবেলায় কী হতে চেয়েছিলেন?
মা–বাবা চাইতেন ডাক্তার হই। কিন্তু বডিবিল্ডার হয়ে গেলাম।
প্রশ্ন :
বডিবিল্ডিংয়ের শুরুর গল্পটা বলবেন?
২০১৭ সালের শেষ। পতেঙ্গা নৌবাহিনী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর ভারতের পাঞ্জাবে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করতে যাই। ওখানে গিয়ে দেখি, রাত আটটা বাজতেই সবাই ক্লাবে চলে যেত। বাসায় বসে আমার তখন সময় কাটত না। সময় কাটাতে জিমে যাওয়া শুরু করি। দু–তিন মাস গিয়ে দেখি বেশ উন্নতি হচ্ছে। তা ছাড়া আমি আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের সিনেমা দেখতাম প্রচুর। বডিবিল্ডিংয়ের অনেক বড় প্রতিযোগিতা হয় আর্নল্ড ক্ল্যাসিক নামে। মনে হলো সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করে দেখি। এরপর পড়াশোনা করে আমেরিকান কাউন্সিল অব এক্সারসাইজ সার্টিফিকেশন করলাম। ২০১৯ সালে দেশে আসি। এরপর কানাডায় গিয়ে পাবলিক হেলথ বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করি। এভাবেই বডিবিল্ডিংয়ে জড়িয়ে গেছি।