তৃষ্ণা মিটিয়ে পুরস্কার পেলেন রাফায়াত

শাহ রাফায়াত চৌধুরী
ছবি: খালেদ সরকার

২০১৩ সাল। ঢাকার স্কলাস্টিকা স্কুলের ক্যানটিনে একদিন ছয় বন্ধুর তুমুল আড্ডা জমেছে। এর মধ্যে হঠাৎই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে একটি সামাজিক সংগঠন শুরুর প্রস্তাব দেয় বন্ধুদের একজন—শাহ রাফায়াত চৌধুরী। এভাবেই টিফিনের ফাঁকে এক আড্ডা থেকেই গড়ে ওঠে রাফায়াতের সংগঠন—ফুটস্টেপস বাংলাদেশ। ছোট পরিসরের উদ্যোগটি দিন দিন বড় হয়ে উঠছে। স্বীকৃতিস্বরূপ রাফায়াত জিতে নিয়েছেন ‘এএফএস প্রাইজ ফর ইয়াং গ্লোবাল সিটিজেনস’ পুরস্কার।

গত বছর থেকে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘এএফএস ইন্টেলেকচুয়াল প্রোগ্রাম’ সম্মানজনক এই পুরস্কারটি দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী তরুণদের শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করছে সংগঠনটি। টেকসই উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য সারা বিশ্বের তরুণদের মধ্যে একজনকে দেওয়া হয় এই পুরস্কার।

প্রকল্পের নাম তৃষ্ণা

২২ অক্টোবর থেকে অনলাইনে শুরু হওয়া দুই দিনের এএফএস গ্লোবাল কনফারেন্সের সমাপনী দিনে চূড়ান্ত বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়। বিজয়ী হিসেবে বাংলাদেশের রাফায়াত পেয়েছেন ১০ হাজার মার্কিন ডলার, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা।

আয়োজকদের ওয়েবসাইট ঘুরে দেখা যায়, রাফায়াতের ‘তৃষ্ণা’ নামের বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি সরবরাহের প্রকল্পটি বিচারকদের নজর কেড়েছে। ২০১৫ সাল থেকে চালু হওয়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও টাঙ্গাইলের প্রায় ৭৫ হাজার মানুষের কাছে বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪২টি স্কুলের ১৪ হাজার শিক্ষার্থীও রয়েছে।

রাফায়াত বলেন, ‘আমরা মূলত সুবিধাবঞ্চিত ও নিম্নবিত্ত মানুষদের জন্য বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করেছি। এ প্রকল্পের মাধ্যমে তাঁদের শুধু পানিই পৌঁছে দেওয়া হয়নি, তাঁদের সামাজিক ও আর্থিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়েছে।’

মূলত করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) তহবিলের সহায়তায় তৃষ্ণা প্রকল্পটি পরিচালিত হয়। প্রথমে উপহার হিসেবে বিনা মূল্যে কোনো একটি এলাকায় পানি পরিশোধনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। এরপর পানি পরিশোধনের জন্য এলাকার বাসিন্দারা নিয়মিত চাঁদা দেন। এভাবে তাঁরা রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বহন করেন। পরে জমা হওয়া বাড়তি অর্থ দিয়ে তাঁরা নিজেরাই একাধিক পানি পরিশোধন যন্ত্র কেনার মতো স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন।

ঢাকায় একটি বাড়ির বাইরে রাখা ফিল্টারে রিকশাওয়ালাদের পানি খাওয়ার ব্যবস্থা আছে—এটি দেখেই তৃষ্ণা প্রকল্পের ভাবনা মাথায় আসে রাফায়াতের। প্রকল্পটি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে নিরাপদ পানির অভাব রয়েছে, এমন কিছু এলাকা ও স্কুল চিহ্নিত করেন তিনি। এরপর প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহের জন্য তাঁরা বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান বরাবর আবেদন করতে শুরু করেন।

বাড়ছে ব্যাপ্তি, মিলছে স্বীকৃতি

রাফায়াত বলেন, ‘শুরুতে আমরা গতানুগতিকভাবে শীতবস্ত্র বিতরণ, খাবার ইত্যাদি দিয়ে মানুষকে সাহায্য করতাম। কিন্তু কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম এভাবে কোনো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। যিনি এ বছর কম্বল নিচ্ছেন, পরের বছর ওই ব্যক্তিই আবার কম্বল নিতে আসছেন।’

তখন থেকে তাঁরা এমন কিছু প্রকল্প নিয়ে ভাবতে শুরু করেন, যেগুলো সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে টেকসই সমাধান নিশ্চিত করে। ফলে মানুষ নিজেই নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে। এরপরই তৃষ্ণাসহ বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষা নিয়ে তাঁরা কাজ শুরু করেন। দ্য ল্যাট্রিন প্রকল্পের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চল টেকনাফের ২০০ পরিবারের জন্য প্রায় ৫০০টি শৌচাগার স্থাপন করা হয়েছে। এদিকে স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য গ্রাফিক ডিজাইন, রোবটিকস ও যৌনশিক্ষার মতো অপ্রচলিত বিষয়ে জ্ঞান বৃদ্ধি করতে চালু করেছে প্রজেক্ট বৃত্ত। এ ছাড়া ফেমপাওয়ার নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ২০০ স্কুলছাত্রী ও গণমাধ্যমকর্মীদের আত্মরক্ষাবিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়েছে তারা। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত মোট ১৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে রাফায়াতের ফুটস্টেপস বাংলাদেশ।

সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের ফলে আগেও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন রাফায়াত। চলতি বছরেই তিনি ডায়না অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। যুক্তরাজ্যের দ্য রয়্যাল ফাউন্ডেশন থেকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।

২০১৮ সালে রাফায়াত পরিবেশ অর্থনীতি ও নীতি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। দেশে ফিরে এখন নিজের সংগঠনেই পুরো সময় দিচ্ছেন। শুরুতে পাঁচ বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এখন সংগঠনের কলেবর বেড়েছে কয়েক গুণ। বর্তমানে স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা ২২। এ ছাড়া এক হাজারেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন দেশজুড়ে।

রাফায়াত জানালেন, পুরস্কারের পুরো অর্থ তৃষ্ণা প্রকল্পে ব্যয় করতে চান। প্রকল্পটি সারা দেশেই ছড়িয়ে দিতে চান তিনি। চলমান অন্যান্য প্রকল্পের ব্যাপ্তি বৃদ্ধিরও স্বপ্ন দেখেন এই তরুণ।