তোমাকে ওর মতো হতে হবে

আহনাফ (ছদ্মনাম) সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। মা-বাবা তাকে খুব আদর করেন। তাঁরা জানেন যে সন্তানকে পড়ার জন্য খুব বেশি চাপ দিতে হয় না, তাঁরা সন্তানকে গুণগত সময় দেন। তাকে নিয়ে বেড়াতে যান। কিন্তু আহনাফের বাবার স্বপ্ন একটাই, তাঁর ছেলে বড় হয়ে অনেক বড় বিজ্ঞানী হবে। তিনি প্রায়ই বলেন, ‘তুমি কেবল স্টিফেন হকিংয়ের মতো বিজ্ঞানী হও।’ তিনি আহনাফকে স্টিফেন হকিংয়ের বই কিনে দেন, পোস্টার কিনে দেন—দিনরাত ছেলের সামনে কেবল স্টিফেন হকিংকে তুলে ধরেন। হকিং হওয়ার এ রকম প্রচেষ্টায় আহনাফের প্রাণান্ত পরিশ্রমে বাবা উৎসাহ দিয়ে যান। দিন শেষে আহনাফ নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকে, কারও সঙ্গে মিশতে পারে না এবং পরীক্ষার ফলও খারাপ হতে থাকে।
দুই.
শর্মীর সমস্যা একটু ভিন্ন। তার মায়ের শখ সে অনেক বড় সংগীতশিল্পী হবে। গানের স্কুলে ভর্তি করা, বাসায় ওস্তাদ রেখে রেওয়াজ করানো, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া—নানাভাবে তাকে একজন দেশসেরা শিল্পী বানাতে চান তার মা-বাবা। তাঁরা বলেন, ‘তোমার গানের গলা ভালো, তোমার ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দরকার নেই, তোমাকে “অমুকের” মতো হতে হবে।’ তাঁরা এক অনুষ্ঠানে সেই ‘অমুকের’ সঙ্গে শর্মীর দেখা করিয়ে দেন, তাকে আশীর্বাদ করতে বলেন। মা-বাবার চাপে সব সময় ‘অমুক’ হয়ে ওঠার তাড়না অনুভব করে শর্মী। নিজের মতো করে কিছু চিন্তা করতেও পারে না।
আহনাফ আর শর্মীর সামনে দুটি বিখ্যাত চরিত্র। মা-বাবা চান, তারা যেন সেই চরিত্র দুটির মতো হতে পারে। আহনাফ আর শর্মীর মতো অনেক মা-বাবা রয়েছেন, যাঁরা তাঁদের সন্তানের সর্বোচ্চ ভালো চান। আর এই ভালো চাইতে গিয়ে তাঁরা সামনের কোনো ব্যক্তিত্বকে ‘আদর্শ চরিত্র’ হিসেবে বেছে নেন। হতে পারে সেই চরিত্রগুলো সামাজিকভাবে বিখ্যাত, আবার হতে পারে পারিবারিকভাবে পরিচিত সফল কেউ একজন। ক্রিকেটে হোক সাকিবের মতো, কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে হোক মার্ক জাকারবার্গের মতো। তাঁদের এই প্রত্যাশা প্রকাশের প্রক্রিয়া অনেক সময় সন্তানের জন্য মঙ্গলজনক হয় না। কখনো দেখা যায়, মা-বাবা সন্তানকে তার চাচা, মামা, চাচাতো-মামাতো-ফুফাতো ভাইবোন বা প্রতিবেশী যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে খুব সফল, তাঁদের মতো হওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে থাকেন। কিন্তু এই উৎসাহিত করার পদ্ধতি যদি সঠিক না হয়, সন্তানেরা উৎসাহিত হওয়ার বদলে ওই চরিত্রের প্রতি বিরূপ হয়ে যায়। আবার মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে না পারার বেদনায় হতাশ হয়ে পড়ে কিংবা তীব্র চাপে নিজের স্বকীয়তা হারায়।
এতে কী সমস্যা হয়?
* শিশুদের যদি সব সময় একটি লক্ষ্য দেখিয়ে বলা হয় তোমাকে ওইখানে পৌঁছাতেই হবে, তবে তার মনে লক্ষ্যের বাইরের কিছু ঢুকতে পারে না। ফলে তার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের পথগুলো বন্ধ হতে থাকে। তার দেখার ক্ষমতা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে, যাকে বলা যেতে পারে টানেল ভিশন। এর ফলে শিশুর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে।
* মানসিক চাপে থাকার কারণে তার প্রকৃত উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হয়। চাপের কারণে তার পড়ালেখা, সামাজিক যোগাযোগ নানা দিকে সমস্যা হতে থাকে। সেরা হতে গিয়ে শিশুটি অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে যায়। মা-বাবার চাওয়া-পাওয়ার মূল্য দিতে গিয়ে সে আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা ও আচরণে অভ্যস্ত হতে থাকে। সামাজিকভাবে অজনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন সময় করা কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, কর্তৃত্বপরায়ণ মা-বাবার সন্তানের বন্ধু কম হয়, তাদের সামাজিক দক্ষতা কম থাকে। আর তারা বন্ধুমহলে মোটেই জনপ্রিয় নয় (ল্যামবোর্ন ১৯৯১, স্টিনবার্গ ১৯৯৪)
* শিশু যখন মা-বাবার নির্দেশিত রোল-মডেলের মতো হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে, তখন বিষয়টি তার সহপাঠী ও বন্ধুদেরও নজরে পড়ে। তারা তাকে এ বিষয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে, ফলে তার মধ্যে ক্ষোভ আর হতাশা জন্ম নিতে পারে।
* একটা পর্যায়ে দেখা যায় সে লক্ষ্য অনুযায়ী এগোতে পারছে না। তখন একদিকে মা-বাবা ক্রমাগত তার প্রতি চাপ বাড়িয়ে দেয়, আরেক দিকে তার মধ্যে হতাশা আর বিষণ্নতার লক্ষণ দেখা যায়। ফলে সে বিকল্প নেতিবাচক উপায়ে—যেমন মাদক গ্রহণ করে, নিজের ক্ষতি করে, আত্মহত্যার চেষ্টা করে ভুলভাবে বিষণ্নতা প্রশমিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে।
* প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব স্বতন্ত্র। ছোটবেলা থেকেই এই ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠতে থাকে।
* শিশুর আত্মবিশ্বাস কমে যায়। সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নিজের ওপর আস্থা রাখতে পারে না।
* যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক লেলা র্যাঙ্কিন উইলিয়ামস এবং মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাথান ফক্স তাঁদের গবেষক দল নিয়ে ১১৩টি পরিবারের শিশু ও তাদের মা-বাবার ওপর ১৫ বছর ধরে গবেষণা করেন। ৪ মাস বয়স থেকে শুরু করে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁরা ওই পরিবারগুলোর শিশু আর তাদের মা-বাবার আচরণ পর্যবেক্ষণ করেন।
* ২০০৯ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে তাঁরা জানান, যেসব শিশুর ওপর তাদের মা-বাবারা নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, শিশুর বিকাশের বিষয়ে কর্তৃত্বপরায়ণ আচরণ করেন, সেসব শিশুর আচরণে নানা ধরনের সমস্যা দেখা যায়। যেমন শিশু হঠাৎ করে রেগে যায়, অবাধ্য ও আগ্রাসী আচরণ করে এবং বন্ধু তৈরি করতে পারে না।
মা-বাবা কেন এমনটা করেন
প্রত্যেক মা-বাবাই চান তাঁর সন্তান সেরা হোক। এই সেরা বানাতে গিয়ে হাতের কাছে সেরার তালিকা থেকে নিজের পছন্দমতো কাউকে বেছে নেন আর সন্তানের সামনে সেই বাছাই করা সেরা চরিত্রকে তুলে ধরেন।
অনেক সময় নিজের অপ্রাপ্তিকে সন্তানের মধ্য দিয়ে পূরণ করতে চান। নিজে যা করতে চেয়েছিলেন, তা করতে পারেননি। এখন সন্তানের মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্নটা পূরণ করতে চান।
সামাজিকভাবে নিজেকে এবং সন্তানকে সব সময় সবার ওপরে দেখতে চান। একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দেন সন্তানকে। কারও অফিস সহকর্মী বা প্রতিবেশীর সন্তান ভিনদেশি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছে—এখন যদি তাঁর সন্তান সে ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পায়, তবে তো নাককাটা যায়! এই তাড়না থেকে সন্তানকে রেসের ঘোড়ার মতো দৌড় প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেন তাঁরা।
নিজের সন্তানকে সামাজিক আর অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে নিরাপদ দেখতে চান সবাই। আর সেরা মানেই সবদিক থেকে নিরাপদ। তাই সামাজিক বৈষম্য যখন বেশি, তখন সেরা না হলেই নিরাপত্তাহীনতা। এই ধারণা থেকে মা-বাবা চান তাঁর সন্তান যেন সেরা হয়।
সামাজিক শিক্ষা জীবনের সামনে সব সময় একটা আদর্শ চরিত্রকে তুলে ধরে। এ রকম শত শত আদর্শ চরিত্র রয়েছে। সন্তানের পছন্দ হয়তো চিত্রকলার আদর্শ কেউ কিন্তু মা-বাবা তার সামনে সংগীতের আদর্শ এক চরিত্রকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এটি মা-বাবার সামাজিক দক্ষতার অভাব। তাঁরা সন্তানের মনের ইচ্ছা অনেক সময় বুঝতে পারেন না।
কী করা উচিত
নিজের সন্তানের সাফল্য সবাই চায়। আর সাফল্যের জন্য প্রয়োজন প্রেরণা। মনে রাখতে হবে, প্রেরণার বদলে মা-বাবা যেন তাড়া সৃষ্টি না করেন। বিকাশের পর্যায়ে কোনো ব্যক্তিকে রোলমডেল রাখা, আদর্শ ব্যক্তিত্বকে অনুকরণ করা যেতে পারে, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে প্রত্যেক শিশুই স্বতন্ত্র, রোলমডেলকে অনুসরণ করতে গিয়ে যেন শিশুর ক্রমবিকশিত ব্যক্তিত্ব বিলীন না হয়ে যায়। এ জন্য—
* শিশুর মনকে পড়তে শিখুন। সে কী হতে চায়, সেটাকে গুরুত্ব দিন। আপনার চাওয়াটা তার ওপর চাপিয়ে দেবেন না।
* শিশুকে কেবল আদেশ পালনকারী-অনুগত করাই যথেষ্ট নয়, তাকে দায়িত্বশীল হতে শেখান।
* কেবল স্কুল-কলেজের পরীক্ষার ফলকে গুরুত্ব না দিয়ে শিশুর মধ্যে সামাজিক দক্ষতা আছে কি না, সেদিকে নজর দিন। পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ডের নম্বরের চেয়ে শিশুর সামাজিক দক্ষতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
* শিশুকে কারও সঙ্গে তুলনা করবেন না, ‘অমুকের মতো হতেই হবে’ এমন শর্ত বা নির্দেশ দেবেন না।
* প্রত্যেকের সক্ষমতা সমান নয়। শিশুর সক্ষমতা আর দুর্বলতার দিক চিহ্নিত করুন। ও যা ভালো পারে, সেটি করতে উৎসাহিত করুন। দুর্বল দিকের পরিচর্যা করুন। ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে দুর্বলতাকে আরও বাড়াবেন না।
* শিশুকে কিছুটা নিজস্ব সময় দিন, যাতে সে নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারে। সে যতই ছোট হোক না কেন, তার সব ভাবনা আপনি ভেবে দেবেন না। তাকে সঠিক পথে ভাবতে সাহায্য করতে পারেন কিন্তু আপনার ভাবনাগুলো তার ওপর চাপিয়ে দেবেন না।
* খুব সফল কোনো ব্যক্তিত্বকে শিশুর সামনে রোলমডেল হিসেবে উপস্থিত না করে মা-বাবা নিজেরাই তাঁদের সন্তানের রোলমডেল হতে পারেন। গবেষণায় এটাও প্রমাণিত হয়েছে, যে শিশু নিজের মা-বাবাকে আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসেবে অনুসরণ করে, তারা সামাজিকভাবে অনেক দক্ষ হয়। তাদের আচরণ পরিশীলিত হয়, যার ক্রমপরিণতি হচ্ছে সামাজিক সফলতা।
* সফলতার পাশাপাশি শিশুর ব্যর্থতাকেও মানতে শিখুন। কোনো কারণে শিশু পড়ালেখাসহ যেকোনো বিষয়ে ব্যর্থ হলে মা-বাবা যেন কখনো ভেঙে না পড়েন, হতাশ না হন। কারণ, মা-বাবার হতাশা আর ভেঙে পড়া শিশুকে হতাশ করবে, তাকে বিষণ্নতায় আক্রান্ত করবে।
* শিশুর যেকোনো নেতিবাচক আচরণকে (যেমন মাদক গ্রহণ, নিজের শরীরে আঘাত, আত্মহত্যার প্রবণতা ইত্যাদি) গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সেগুলো কমানোর চেষ্টা করুন, শিশুকে বুঝতে শিখুন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।