তোমার ছেলে এটা কী করছে?

সন্তানের সামনে মা–বাবার ঝগড়া সন্তানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ​মডেল: সাদিয়া, তারেক ও আরিয়ান। ছবি: সুমন ইউসুফ
সন্তানের সামনে মা–বাবার ঝগড়া সন্তানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ​মডেল: সাদিয়া, তারেক ও আরিয়ান। ছবি: সুমন ইউসুফ

পরীক্ষায় ভালো ফল করল বাড়ির ছেলেটি। তখন অনেক বাবাকে বলতে শোনা যায়—‘দেখতে হবে না কার ছেলে? আমার ছেলে তো আমার মতোই হবে। মায়ের মতো কম বুদ্ধি হয়নি।’ উল্টো দৃশ্যও দেখা যায়—ছেলে কোনো ঝামেলা করেছে, অমনি মা বাবাকে দুষলেন। ‘এই যে দেখো, তোমার ছেলে কী করেছে? এখন ঠ্যালা সামলাও!’ এর জবাবে বাবা আবার মায়ের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করতে থাকেন। পরস্পরের ওপর দোষরোপ করতে থাকেন তাঁরা। মানে ভালো কিছু হলে ‘ছেলে–মেয়ে আমার’, খারাপ করলে ‘তোমার’।

অন্যকে দোষ দেওয়ার প্রবণতা মানুষের মধ্যে থাকে। মা–বাবা যখন সন্তানের সামনে পরস্পরকে দোষারোপ কিংবা বেশি প্রশংসা করতে থাকেন, সেটি সন্তানের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনে না। ‘আমার ছেলে আমার মতো। তাই তো এত ভালো করছে’—এ ধরনের প্রশংসাসূচক কথার মধ্য দিয়ে এক ধরনের অহংবোধ প্রকাশ পায়। সন্তানের মধ্যেও তা সংক্রমিত হয়।

হাফিংটন পোস্টের ডেভেলপমেন্ট সাইকোলজিষ্ট ডায়না ডিভেকা তাঁর একটি গবেষণাধর্মী লেখায় লিখেছিলেন, সন্তানদের মধ্যে মা–বাবার প্রভাব বেশি থাকে। মা–বাবা পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকলে সন্তান ভুল বোঝে। সন্তান ধরেই নেয় সে যে কাজটি করেছে, তা অত গুরুতর নয়।’ ডায়না নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন—ছোটবেলায় মা–বাবার ঝগড়া দেখে তিনি ঠিক করেছিলেন, নিজে যখন সন্তানের মা হবেন, কখনো সন্তানের সামনে ঝগড়া করবেন না। মা–বাবা ঝগড়া করলেই তাঁর দম আটকে আসত। মন হতো চারপাশে অক্সিজেনের অভাব। আত্মবিশ্বাসও কমে গিয়েছিল।

কয়েকদিন আগে ঢাকার এক স্কুলের সামনে এক অভিভাবককে দেখলাম খুব উত্তেজিত হয়ে বাচ্চাকে ধমকাচ্ছেন। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম শুনতে পেলাম, তিনি বলছেন, ‘বাবার মতো হয়েছিস? ভালো কিছু তো শিখলি না।’ অপরাধীর মতো মুখ করে বাচ্চাটি মায়ের কথা শুনছিল।

সাময়িকভাবে মা–বাবা হয়তো তাঁদের রাগ কমানোর জন্য এ ধরনের কথা বলেন। কিন্তু এতে সম্পর্কের প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হয়ে যায়। সে ভাবে, মা–বাবা যেহেতু পরস্পরকে শ্রদ্ধা করেন না, আমিও করব না।

সন্তানের ওপর মা–বাবার নিয়ন্ত্রণও ধীরে ধীরে কমতে থাকে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মেখলা সরকার মনে করেন, সন্তানের সামনে মা–বাবার পরষ্পরের দিকে আঙুল তুলে প্রশংসা বা দোষারোপ কোনটিই সন্তানের জন্য ভালো নয়। এতে সন্তান ভালো আর মন্দের তফাৎ করতে পারে না। তার কাছে মা–বাবা তো ভালোই, তাহলে মা–বাবা পরষ্পরকে খারাপ বলছে কেন? তাহলে কী তাঁরা ভালো নন?

সন্তান এক ধরনের দ্বিধা–দ্বন্দ্ব নিয়ে বড় হতে থাকে। এর সমাধান যদি সে বড় হয়ে করতে পারে, তাহলে তো ভালোই। গবেষণা বলে বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে তা পারে না। তাদের চরিত্র সরলভাবে তৈরি হয় না।

ঝগড়া হতে পারে, এমনকি খুনঁসুটিও হতে পারে—তখন কোন ধরনের কথা বলা উচিত বা কী বলব—সেটা খুব জরুরি। সন্তানের সামনে ঝগড়া না করে ঘরের দরজা আটকে আলাদাভাবে তর্ক করতে পারেন। পারষ্পরিক সম্মান শ্রদ্ধা বজায় রেখে তা করুন। একান্তই না পারলে অন্তত সন্তানের সামনে বোঝান যে আপনারা একটা ঐক্যমতে পৌঁছেছেন। তা না হলে সন্তান মনে করবে, মা–বাবার বন্ধন দৃঢ় নয়। এটি তার মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ সৃষ্টি করে।

১৭ থেকে ১৯ বছরের ছেলেমেয়েদের নিয়ে করা একটি জরিপ প্রকাশিত হয় দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। তাতে বলা হয়েছে, এই ছেলেমেয়েদের রাগ,আক্রমণাত্মক মনোভাব অন্যদের থেকে বেশি। তারা মা–বাবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল না। কারণ, তাঁরা ঝগড়া করেন।

দিনশেষে তারা মা–বাবার মুখে হাসি দেখতে চান। সত্যিকারের সুন্দর পরিবার চান। সন্তানের এই চাওয়া পূরণ করতে পারে মা–বাবা। সন্তানের জন্য তো কত কষ্টই করেন। সন্তানের সুন্দর মন মানসিকতা গঠনের জন্য আরেকটু চেষ্টা না হয় করলেন। তাতে যেমন আপনার লাভ, দেশেরও লাভ।