সম্প্রতি রাজধানীতে একটি নির্মাণাধীন ভবন থেকে ইট পড়ে এক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ রকম ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগে নির্মাণাধীন ভবন থেকে নির্মাণসামগ্রী পড়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু বাড়ি বা দালান নির্মাণের ক্ষেত্রে রয়েছে যথাযথ আইনকানুন। অনেকেই হয়তো জানেন না কিংবা জানলেও মানেন না। আর এই আইনকানুন মানা হচ্ছে কি না, এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের তদারকির ঘাটতি দেখা যায়।
২০১১ সালের ১৬ জুলাই অসুস্থ মাকে হাসপাতালে দেখে ফেরার পথে পান্থপথে শমরিতা হাসপাতালের সামনে একটি নির্মাণাধীন ১৮তলা ভবন থেকে ইট পড়ে মারা যান তেজগাঁও কলেজের ছাত্র হাবিবুর রহমান। এ ঘটনার পর হাইকোর্ট বিভাগ স্বপ্রণোদিত হয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে একটি রিট জারি করেন। আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন ডেভেলপার কোম্পানির চেয়ারম্যান, রাজউকের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে। পরবর্তীকালে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে আদালত নির্দেশ দিয়েছিলেন নির্মাণপ্রতিষ্ঠানকে। তাই আইন না মেনে এবং পথচারীদের যথেষ্ট নিরাপত্তা না দিয়ে ভবন নির্মাণ করলে শাস্তি অবধারিত।
দেশে ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২ প্রচলিত আছে। এ ছাড়া ২০০৬ সালে প্রণয়ন করা হয়েছে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা। এই আইন ও বিধিমালা অনুসারে ভবন নির্মাণে পথচারীদের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ বিধিবিধান না মানলে সরকারের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ওই ইমারত ভেঙে ফেলার বা অপসারণের নির্দেশ দিতে পারবে। আবার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে অবৈধ ইমারত ভেঙে ফেলতে বা অপসারণ করতে পারবে। আইন অমান্যকারীকে কোনো রকম পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তার করতে পারবে।
যা মানতে হবে
ইমারত বা ভবনসংলগ্ন রাস্তা বা এর সঙ্গে সংযোগকারী প্রশস্ত রাস্তা থাকতে হবে। কোনো ইমারত খোলা বৈদ্যুতিক লাইন থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড অথবা ঢাকা বিদ্যুৎ সরবরাহ কর্তৃপক্ষের নিয়ম মোতাবেক নিরাপদ দূরত্বে নির্মাণ করতে হবে। বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে আইনে পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। সর্বোচ্চ সাততলা ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, গ্যাস, ওয়াসা ও বিদ্যুৎ বিভাগের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। নির্মাণাধীন ভবনের চারপাশ জাল দিয়ে ঢেকে ও নিরাপত্তা-মাচা তৈরি করে বহুতল ভবন নির্মাণের বিধান রয়েছে। নির্মাণাধীন ভবনের চারপাশ নাইলনের জাল দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। নির্মাণসামগ্রী যেন পড়ে না যায়, সে জন্য বাইরের দেয়ালে নিরাপত্তামূলক মাচা (ক্যানোপি) রাখতে হবে। এ মাচা থাকবে নির্মাণকাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। শুধু জাল বা মাচার যেকোনো একটি ব্যবহার করা যাবে না। ব্যবহার করতে হবে দুটিই। এ ছাড়া ভবনের চারপাশে নোটিশ বোর্ডে পর্যাপ্ত বিপদের চিহ্ন অথবা রঙিন আলো দিয়ে বিপদ চেনার ব্যবস্থা করতে হবে। বিধি অনুসারে, নিরাপত্তার এসব ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন ভবনমালিক বা নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন এলাকায় ইমারত নির্মাণকালে যেকোনো দুর্ঘটনার জন্য ভবনমালিক দায়ী থাকবেন। তা ছাড়া ভবন নির্মাণস্থলে দুর্ঘটনাসহ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়ানো, ভূমিধস রোধ, কর্মরত নির্মাণশ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধান, আশপাশের ভবন, অবকাঠামো ও পথচারীদের নিরাপত্তাও সংশ্লিষ্ট ভবনমালিক কিংবা নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানকে নিশ্চিত করতে হবে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এ–সংক্রান্ত একটি আদেশও রয়েছে। আদেশে ইমারত নির্মাণ বিধিমালাসহ অন্যান্য বিধিমালা অনুসরণ করে অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে ইমারত নির্মাণ ও নির্মাণকালীন সব ধরনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য রাজউকের পক্ষ থেকে মালিক ও নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানকে বলা হয়েছে। কেউ ভবন তৈরিতে এসব বিধিবিধান অমান্য করলে সরকার ইচ্ছা করলে সেই ইমারত ধ্বংস করতে পারে এবং দায়ী ব্যক্তিদের সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।