দূরত্ব ঘুচুক ভাইবোনের সম্পর্কের

কাছাকাছি বয়সের ভাইবোনেরাই প্রথম খেলার সাথি, প্রথম বন্ধু। ছবিটি প্রতীকী।
কাছাকাছি বয়সের ভাইবোনেরাই প্রথম খেলার সাথি, প্রথম বন্ধু। ছবিটি প্রতীকী।

পৃথিবীতে ভাইবোনের সম্পর্কই বোধ হয় সবচেয়ে মধুর ও কোমল। আদরে-ভালোবাসায়, আহ্লাদে-আবদারে ভরা এই মিষ্টি সম্পর্কের মধ্যেও অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝি এবং দূরত্ব তৈরি হতে পারে। তীব্র আবেগ থাকে বলে খুব ছোট্ট কোনো সমস্যা থেকেও তীব্র মান-অভিমান তৈরি হয় ভাইবোনদের মধ্যে। তাই ছোট্ট এ সমস্যাগুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে, না হলে তা বাড়তে বাড়তে দূরত্ব বাড়িয়ে দিতে পারে ভাইবোনের সম্পর্কেও।
পিঠাপিঠি ভাইবোন
পিঠাপিঠি দুই ভাই, দুই বোন বা ভাইবোনের সম্পর্ক খুবই দারুণ হয়। রিমকি আর চুমকির (ছদ্মনাম) গল্পও সে রকমই। এ দুই বোন পড়াশোনা করছেন ঢাকার সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে। একই স্কুল-কলেজে একই ক্লাসে পড়েছেন, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও এখন একসঙ্গে একই বিষয়ে পড়ছেন। সমবয়সী রিমকি-চুমকির বন্ধুত্বও দারুণ। কিন্তু প্রায়ই তাঁদের মধ্যে মান-অভিমান লেগে থাকে। রিমকি জানান, মাঝেমধ্যে হালকা খুনসুটি থেকে তাঁদের ঝগড়া লেগে যায়। ঝগড়া ভাঙতে সময় লাগে। তবে, কোনো কিছু নিয়ে অভিমান হলে সেটা বেশিক্ষণ থাকে না।

কী নিয়ে অভিমান হয় জানতে চাইলে রিমকি বলেন, ‘চুমকি অনেক গোছানো স্বভাবের কিন্তু আমি সবকিছু গুছিয়ে রাখতে পারি না। এ নিয়ে বেশি রাগারাগি হলে অভিমানে আমরা কথা বলা বন্ধ করে দিই। এ নিয়ে আমাদের প্রায়ই সমস্যা হয়।’ এদিকে, চুমকি বলেন, ‘আমরা সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকলেও আমাদের অনেক গোপনীয়তা থাকে, যা আমরা চাইলেও সবটুকু শেয়ার করতে পারি না। বন্ধু হলেও একটু দূরত্ব আছেই আমাদের মধ্যেও।’

মনো-চিকিত্সক ও লেখক ড. মোহিত কামাল মনে করেন, ভাইবোনের সম্পর্ক অনেক মধুর হলেও এই মধুর সম্পর্কেও কখনো কখনো সংঘাত থাকতেই পারে। তিনি জানিয়েছেন, ব্যক্তিত্ব, মূল্যবোধ কিংবা পারিবারিক আবহের কারণেও এরকম সংঘাত বা দূরত্ব তৈরি হতে পারে। তবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করতে হবে।

বয়সের ব্যবধান

ভাইবোনদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান অনেক বেশি হলেই কি সম্পর্কের মধ্যে দূরত্বও অনেক বেড়ে যায়? সবাই তা মনে করেন না। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক মেহেদী কায়সার পবিত্র জানান, ছোট ভাই পদ্মের সঙ্গে তাঁর বয়সের ব্যবধান প্রায় ২১ বছর। কিন্তু বয়সের পার্থক্য দুই ভাইয়ের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে পারেনি।

পবিত্র বলেন, ‘আমি ওর সঙ্গে অনেক কিছু শেয়ার করি। আমরা একসঙ্গে গিটার, কি-বোর্ড বাজানো থেকে শুরু করে খেলাধুলাও করি।’ পদ্ম বয়সে অনেক ছোট বলে ওর প্রতি আলাদা দায়িত্ব বোধ করেন এবং এ জন্য বাড়তি সময়ও দেওয়ার চেষ্টা করেন পবিত্র। তবে ছোট ভাইটি কথা না শুনলে মাঝেমধ্যে খুব অভিমান হয় পবিত্রের। এই বিষয়ে পদ্ম জানায়, ‘ভাইয়া আমার অনেক  ভালো বন্ধু। কিন্তু আমাদের অনেক অমিল। আমার কোনো কাজে ভাইয়া না বললে আমার অনেক কষ্ট হয়, মন খারাপ হয়। তবে, আমি একটু বেশিই দুষ্টামি করি।’

কাছাকাছি ভাইবোনদের মান-অভিমান

কাছাকাছি বয়সের দুই সন্তানের মধ্যেও বাবা-মা বা বড় ভাইবোনদের কাছ থেকে আদর-যত্ন পাওয়া নিয়েও শিশুদের মনোজগতে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে। একই সময়ে বেড়ে ওঠা শিশুরা পরস্পরের বিষয়গুলো ভালোভাবেই লক্ষ করে বলে ওদের চোখে এমন অনেক কিছুই এড়ায় না যা হয়তো বড়রা ওইভাবে খেয়াল করেন না।

মনো-চিকিত্সক মোহিত কামাল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘দুই সন্তানের মধ্যে ছোট সন্তানের প্রতি বেশি যত্নশীল হলে বড় সন্তান তা খেয়াল করে কষ্ট পায়। তখন দুজনের একটা মানসিক দূরত্বের সৃষ্টি হয়। অভিভাবকদের উচিত বড়কে আদর করে তারপর ছোটকে আদর করা অথবা বড়কে বোঝানো যে তাকেও ছোটবেলায় এমন আদর দেওয়া হয়েছিল।’

সময় দেওয়া জরুরি বিষয়

দূরে দূরে থাকলে অনেক সময় ভাইবোনের পারস্পরিক মায়া-মমতা বাড়ে আবার কাছে থাকলে নানান বিষয়ে মন-কষাকষি বা একটু দূরত্ব হতেই পারে। তবে, সম্পর্কে যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্ব তৈরি না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখুন। তাই প্রয়োজন একে অপরকে বোঝা। রাগ-অভিমানের অপর পিঠেই লুকিয়ে থাকে ভালোবাসা। তাই অভিমান বা রাগ লালন না করে ভাইবোনের কাছে নিজের খারাপ লাগার কথা খোলাখুলি বলুন। শেয়ার করুন নিজের চাওয়া আর ভালো লাগার কথাও। দূরত্ব আপনাকে দূরেই ঠেলে দেবে।  তাই সম্পর্ক দূরত্ব সৃষ্টির আগেই কেন এমন হচ্ছে তার কারণ খুঁজতে চেষ্টা করুন।

এ প্রসঙ্গে মোহিত কামাল বলছেন, ‘একটা ঘটনা দিয়েই জীবনকে মাপবেন না। দূরত্ব হতেই পারে। কিন্তু দূরত্ব যাতে না বাড়ে, সে জন্য অনেক কিছু মেনে নিতে হবে। একে অন্যকে ছাড় দিতে হবে, বড় ভাইবোনদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং ছোটদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে, সর্বোপরি নিজের ভুল স্বীকার করার মানসিকতা থাকতে হবে। তাহলেই একটা পরিবার আনন্দময় থাকবে।’

ভাইবোন যে বয়সেরই হোক না নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং ছোটদের প্রতি বন্ধুসুলভ হলে কখনোই দূরত্বও সৃষ্টি হবে না। এতে সম্পর্কও হবে অনেক গাঢ় ও মজবুত। অনেক কাজের ব্যস্ততার মাঝেও  ভাইবোনের জন্য আলাদা সময় বের করুন। দেখবেন অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।