দেশীয় ফ্যাশন প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড হয়ে ওঠা

আড়ং, অঞ্জন’স, নিপুণ, কে-ক্র্যাফট, রঙ, প্রবর্তনা, বাংলার মেলা, নগরদোলা, বিবিআনা, দেশালসহ অনেক বুটিকই নামী ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।
আড়ং, অঞ্জন’স, নিপুণ, কে-ক্র্যাফট, রঙ, প্রবর্তনা, বাংলার মেলা, নগরদোলা, বিবিআনা, দেশালসহ অনেক বুটিকই নামী ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।

বাজারের বিকাশের মধ্য দিয়ে একসময়ের ঘরোয়া বা শৌখিন বুটিক হাউসগুলো বর্তমানে রূপ নিয়েছে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডে। বৈচিত্র্যময় ডিজাইন, নান্দনিকতা আর দেশীয় ভাবধারার এই পোশাকের দিকে সব বয়সী মানুষই ঝুঁকছেন। তাই চাহিদার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় পোশাকের বাজার প্রতিনিয়তই বড় হচ্ছে।

ফ্যাশন উদ্যোক্তাদের সংগঠন ফ্যাশন এন্ট্রাপ্রেনিউরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ফ্যাশন বাজারের ব্যাপ্তি ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এক দশক আগেও এটা ছিল এক হাজার কোটি টাকার মতো। এ থেকেই দেশীয় ফ্যাশনের বিস্তৃতির বিষয়টি বোঝা যায়।

স্বাধীনতার পরবর্তী ১০ বছরে দেশীয় পোশাকের নতুন ধারণা নিয়ে প্রথমে রূপায়ণ ও নিপুণ এবং পরে আড়ং যাত্রা শুরু করে। দেশজ পোশাকের নতুন ধারণা দিয়ে বুটিককে পরিচিত করে তুলে। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১০ বছরে কারিকা, কুমুদিনী, সেতুলী, জয়া, শুকসারি, টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরসহ আরও বেশ কয়েকটি বুটিক কারু ও পোশাকশিল্পকে দেশজ ভাবনার আলোকে উপস্থাপিত করার চেষ্টা করে। তাদের প্রচেষ্টার সাফল্যও আসে। এর বিকাশ ঘটে আশির দশকে। যুক্ত হয় নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান।

এসব প্রতিষ্ঠান বিপ্লব ঘটায় দেশীয় ফ্যাশনে। দেশীয় কাপড়, দেশীয় বুননে রং ও নকশার বৈচিত্র্যে এসব পোশাক উত্সব-পার্বণে ক্রমেই হয়ে ওঠে সবার পছন্দের। কারণ, দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে ধারণ করে সেসব পোশাকে তুলে ধরা হয় নানাভাবে।

মগবাজার আড়ংয়ে ঈদের পোশাক পছন্দ করছেন দুই ক্রেতা। ছবি: ইউসুফ সা’দ
মগবাজার আড়ংয়ে ঈদের পোশাক পছন্দ করছেন দুই ক্রেতা। ছবি: ইউসুফ সা’দ

কিছু উদ্যমী এবং স্বাপ্নিক তরুণ দেশে তৈরি কাপড় দিয়ে ফ্যাশনেবল পোশাক বানানোর যে প্রবণতা চালু করেছিলেন সেটা আজ নগর জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটা অংশ হয়ে উঠেছে। একসময় পাশ্চাত্য ফ্যাশনের ওপর অনুরক্তদের একটি বড় অংশই বর্তমানে দেশীয় কাপড়ে তৈরি পোশাক পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এই তরুণেরা ফ্যাশনের লক্ষণীয় পরিবর্তনের প্লাটফর্ম তৈরির লক্ষ্যে নিরন্তর কাজ করে দেশীয় ফ্যাশনের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ তৈরি করেন। তাঁদের সেই পথ বেয়ে ফ্যাশন জগতে একটা শৈল্পিক বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। বর্তমানে প্রায় শতাধিক ব্র্যান্ডের ফ্যাশন হাউস নিজস্বতা তথা শিল্পের স্বাক্ষর রেখে ফ্যাশনের উজ্জ্বল দিগন্তকে আরও দ্যুতিময় করে তুলতে চালিয়ে যাচ্ছে নানা সুচারু কর্ম।

আড়ং, অঞ্জন’স, নিপুণ, কে-ক্র্যাফট, রঙ, নগরদোলা, দেশালসহ অনেক বুটিকই নামী ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। যুক্ত হয়েছে বাংলার মেলা, ওজি, প্রবর্তনা, বিবিআনার মতো প্রতিষ্ঠান। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরেও বিস্তৃত করেছে নিজেদের বিক্রয়কেন্দ্র। রপ্তানি শুরু করেছে বাংলাদেশি পোশাকের। একসময়ের ঘরোয়া বা শৌখিন আঙ্গিকে গড়ে ওঠা ছোট বুটিকের অনেক দোকানই বাজার বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে রূপ নিয়েছে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডে।

ফ্যাশন হাউসগুলোর উদ্যোগের কারণে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দেশের মানুষের পোশাক কেনার অভ্যাসেও বিরাট পরিবর্তন এসেছে। আগে শুধু মাত্র ঈদ-পূজায় কেনাকাটা হলেও এখন সব ধরনের উত্সবে পোশাক কেনার হিড়িক পড়ে যায়। দুই দশক আগেও এমনটা লক্ষ্য করা যায়নি। বলা যায়, ফ্যাশন হাউসগুলো

ফ্যাশন ব্র্যান্ড সাদাকালোর ঈদ পসরা। ছবি: ইউসুফ সা’দ
ফ্যাশন ব্র্যান্ড সাদাকালোর ঈদ পসরা। ছবি: ইউসুফ সা’দ

আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে বলেই ক্রেতারা সানন্দে দেশীয় কাপড়ে তৈরি পোশাক কিনতে ক্রমে আরও আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রুচিশীলতা।

ফ্যাশন এন্ট্রাপ্রেনিউরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও অঞ্জনসের প্রধান নির্বাহী শাহীন আহমেদ মনে করেন

বসুন্ধরা সিটির দেশী দশে দেশালের শো-রুমে ক্রেতারা। ছবি: ইউসুফ সা’দ
বসুন্ধরা সিটির দেশী দশে দেশালের শো-রুমে ক্রেতারা। ছবি: ইউসুফ সা’দ

গত কয়েক দশকে মানুষের মধ্যে সচেতনতা এসেছে। ‘বিদেশি পোশাক মানে ভালো’—এ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছেন ক্রেতারা। তাঁরাও বিপুল উত্সাহে দেশীয় পোশাককে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন।
গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশি ফ্যাশনের যে বিবর্তন তাতে বড় ভূমিকা তরুণদের বলে মনে করেন ডিজাইনাররা। তারুণ্যের ফ্যাশনের কথা মাথায় রেখেই ফ্যাশনে নতুনত্ব আনার লক্ষ্যে ডিজাইনাররা কাজ করেন।

ফ্যাশন ডিজাইনার মাহিন খান বলেন, ফ্যাশন-বিষয়ক চিন্তাচেতনা এখন বেশ বদলে যাচ্ছে। এখনকার ফ্যাশনে বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন আঙ্গিক। দেশজ ও আন্তর্জাতিক উপকরণ আর নকশার মিশ্রণে পরিবেশিত হচ্ছে এখনকার পোশাক। যারা এ কাজটি করতে পেরেছেন এবং পারছেন তারাই ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন।

ফ্যাশন হাউজ রঙের স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার বিপ্লব সাহা মনে করেন, দেশীয় বুটিক হাউসগুলো এখন একটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেলেও একে এগিয়ে নিতে সরকারের নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন। এ খাতে ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক উদ্যোগ নিলে ব্র্যান্ডগুলো আরও আলো ছড়াবে। নতুন ব্র্যান্ড গড়ে উঠবে।

এ বিষয়ে একমত আড়ংয়ের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজেসের জ্যেষ্ঠ পরিচালক তামারা আবেদ। তিনি মনে করেন, ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে দেশজ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের গুণগত মান বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে পোশাকে এনেছে বৈচিত্র্য ও অভিনবত্ব। এটার পেছনে ভোক্তার চাহিদার একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। ব্র্যান্ডের স্থায়িত্ব ও নতুন ব্যান্ড তৈরি জন্য গবেষণা, নতুনত্ব ও বৈচিত্র্য তৈরিতে আরও মনোযোগী হওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন।

ব্র্যান্ড বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) শিক্ষক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার মনে করেন, দেশীয় ব্যান্ডগুলোকে সত্যিকারের ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে উঠতে আন্তর্জাতিকীকরণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। প্রথমে আঞ্চলিক ও পরবর্তীকালে বিশ্ব পরিমণ্ডলে নিজেদের ব্র্যান্ডের বিস্তারের চেষ্টা করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে দেশীয় পোশাক প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজার ও রপ্তানির সুযোগ বাড়বে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, দেশীয় পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আর শৌখিন ক্ষুদ্র দোকান বা বুটিক হাউসে সীমিত নেই। ছোট থেকে যাত্রা শুরু করে অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন একেকটি প্রতিষ্ঠান। তাদের পুরো কর্মকাণ্ডই এখন একটি বিকাশমান শিল্প। কিন্তু এ শিল্পের জন্য সরকারের দিক থেকে নেই কোনো নীতিমালা ও দিকনির্দেশনা।

নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও দেশীয় উদ্যোক্তারা এখানে বসে নেই। বাজার সম্প্রসারণের জন্য শুরুতে নিপুণ, রঙ, কে-ক্র্যাফট, সাদাকালো, অঞ্জনস, বিবিয়ানা, দেশাল, প্রবর্তনা, নগরদোলা ও বাংলার মেলা—এ ১০টি দেশীয় ব্র্যান্ডের ফ্যাশন নিয়ে সম্মিলিত আয়োজন করেছে ‘দেশী দশ’। পরবর্তীকালে আরও ১০টি ফ্যাশন হাউজ অন্যমেলা, এড্রয়েট, এম ক্র্যাফট, টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির, নবরূপা, ব্লু আইস, ম্যাকয়, স্মার্টেক্স, শৈল্পিক ও স্টুডিও এমদাদ নিয়ে আরেকটি প্রতিষ্ঠান ‘স্বদেশী’ গড়ে উঠেছে।

সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার মনে করেন, সম্মিলিত এ উদ্যোগের ভাবনাকে মাথায় রেখে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে ফ্যাশন হাউসগুলো। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফ্যাশন শো ও ফ্যাশন মেলায় অংশ নিয়ে দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পারে। আর তার মাধ্যমে দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো সত্যিকারের ব্র্যান্ডে পরিণত হতে পারবে।

দেশীয় ফ্যাশন
দেশীয় ফ্যাশন