ঢাকা থেকে ভারতের কলকাতা হয়ে মুম্বাই বিমানবন্দর। তারপর বাস ধরে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে মহারাষ্ট্রের লোনাভালার হোটেলে যখন পৌঁছালাম, তখন রাত আড়াইটা। আমি আর শাহজাদা আউয়াল শাহ এসেছি টাটা আলট্রা ম্যারাথনে অংশ নিতে। বেলা ১১টায় বাসে করে ম্যারাথনের ৫০ কিলোমিটার পথ দেখতে যাব। আর মধ্যরাতে শুরু হবে ম্যারাথন পর্ব। তাই রাতে ভালো ঘুম দরকার। তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুমের চিন্তায় উধাও হলো ঘুম!
ম্যারাথন শুরুর সকালে
১৪ মে সকাল ১০টা। হোটেল থেকে বের হলাম মোমের জাদুঘরের উদ্দেশে। সুনীল ওয়াক্স মিউজিয়াম নামের এই জাদুঘর থেকেই দৌড় শুরু হওয়ার কথা। আমরা সেখানে পৌঁছে একটা বাসে উঠলাম। দুই কি তিন কিলোমিটার বাসে যাওয়ার পরই পাহাড়ি পথের শুরু। মাঝে বেশ অনেকটা রাস্তা পাথুরে, খানাখন্দে ভরা। পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথে চলার সময় বাসের ইঞ্জিন খ্যাপাটে আওয়াজ করছিল, বুঝলাম রাতে এ পথে দৌড়ানো সহজ হবে না। বেশ কিছু চড়াই-উতরাই পার করে শেষ পর্যন্ত ‘ফিনিশ পয়েন্টে’ এসে গাড়ি থামল।
শেষ প্রান্ত ঘুরে হোটেলে ফিরলাম। শাহজাদাকে বললাম, ‘ভাই, আমার দ্বারা এই কর্ম হবে না। আমার যাওয়া মানে জেনেশুনে বিষ পান করা!’ সে হাসতে হাসতে অভয় দিল।
রাতে শুরু ম্যারাথন
রাত সাড়ে ১১টায় হোটেল থেকে বের হলাম। দূরত্ব সাড়ে তিন কিলোমিটার। এত রাতে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। দুজনে হাঁটা শুরু করলাম। হাতে টর্চলাইট। দেড় কিলোমিটার যাওয়ার পর একটা গাড়ি এসে কাছে থামল। কেউ একজন বললেন, ‘উঠে পড়ুন।’ বুঝলাম ভদ্রলোক আমাদের মতো ম্যারাথনে অংশগ্রহণকারী। কথায় কথায় জানালেন, গোয়া থেকে তিনি এসেছেন। নাম সুনীল যাদব। প্রাণবন্ত, হাসিখুশি মানুষ। আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে অবাক।
নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা পর শুরু হলো দৌড়। রাত তখন একটা। শুরুর কয়েক কিলোমিটার রাস্তা বেশ ভালোই মনে হলো। অতটা চড়াই ছিল না। হাতিরঝিলের সেতুগুলোর উচ্চতার সমান উঁচু। শাহজাদা ব্যাকরণ মেনে দৌড় শুরু করলেও আমি ব্যাকরণের ধারেকাছে নেই। তাই আমার দৌড়ানোর গতি তার তুলনায় একটু বেশিই ছিল। এক কিলোমিটার যেতেই বুঝলাম, ব্যাকরণ মানা কেন প্রয়োজন। শাহজাদা আমাকে টপকে চলে গেল। আমি গতি কমিয়ে চলতে থাকলাম। ছয় কিলোমিটার পার করে যখন ঘেমে জবজবা, তখন বাঁ দিকের সাইনবোর্ডে দৃষ্টি পড়ল, ২ দশমিক ৫ কিলোমিটার আপ হিল। মনে মনে বলি, দৌড় আসলে এখান থেকেই শুরু!
পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। মিষ্টি আলোয় দৌড়ানো রোমাঞ্চকর হওয়ার কথা। কিন্তু মেঘের কালো চাদর ঢেকে দিচ্ছিল চাঁদকে। পাহাড়ি পথে হেডলাইটই তখন ভরসা। অন্ধকারে সামনে-পেছনে কেউ নেই। একদল মেঘ এসে ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীরে ঠান্ডা আবেশ বুলিয়ে গেল। মেঘের ভিড়ে চারপাশের কিছুই দেখা যায় না। যতই সামনে এগোচ্ছি, তত ভারী হচ্ছে মেঘ।
প্রথম চড়াই সম্পন্ন করার পর নিজের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। মোটামুটি নিশ্চিত হলাম, দৌড় আমি শেষ করতে পারব।
চড়াই-উতরাই পেরিয়ে চারটার দিকে ২১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলাম। শাহজাদা ততক্ষণে ২৩ কিলোমিটার ইউটার্ন পার করে ২৫ কিলোমিটারে। ইউটার্নের পর রাস্তা পরিচিত। আমিও ইউটার্ন নিয়ে চেনা পথে দৌড়াতে থাকলাম। কিন্তু ৩১ কিলোমিটারের পর ডান দিকের নতুন রাস্তা পড়ল। এরপর টানা চার কিলোমিটার পাথুরে রাস্তা। কালো পাথরগুলো যেন বিদ্রূপ করে বলছিল, এতক্ষণ তো দৌড়ালি, পারলে এখন দৌড়া?
রাতের অন্ধকার কেটে গেল। ভোরের আলো ফুটল। সকাল সাড়ে ছয়টা নাগাদ ৩৫ কিলোমিটার পথ দৌড়েছি। নিজের পারফরম্যান্সে নিজেই মুগ্ধ হচ্ছিলাম! মুগ্ধ হওয়া ছাড়া উপায়ও নেই। ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত নিজের প্রতি মুগ্ধ থাকতে হবে, নিজেকে নিজে ধন্যবাদ দিতে হবে। নয়তো এই দুর্গম গিরি পাড়ি দেওয়া সহজ নয়। মনে মনে বলি, শাহজাদা এতক্ষণে নিশ্চয়ই ৪০ কিলোমিটার সম্পন্ন করেছে।
৪০ কিলোমিটার পর গুনে গুনে ছয়জনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলাম। কাউকে পেছনে ফেলার মধ্যে নির্মল এক আনন্দ পাওয়া যায়! সেই আনন্দেই এগোতে থাকলাম।
বেলা যত বাড়ছে, সূর্যের তেজও বাড়ছে। দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছিল। ৪৫ কিলোমিটার এসে একটু উতরাই পেয়েও স্বস্তি পেলাম না। একদম খাড়া নিচে নেমে গেছে পথ। গতি বাড়ানোর উপায় নেই। শরীরকে কায়দা করে পেছনে হেলিয়ে পায়ের ওপর চাপ দিয়ে দিয়ে সাবধানে নামতে হচ্ছিল। তা–ও ভালো যে ওপরে উঠতে হচ্ছিল না। ভেবেছিলাম, এরপর আর উতরাই থাকবে না। কিন্তু সুখ বেশিক্ষণ সইল না। ৪৮ কিলোমিটারে এসে আবার আপ-হিল। শেষ দুই কিলোমিটারের এই আপ-হিল সবচেয়ে বাজে।
ততক্ষণে শরীরের শক্তি শেষ। পা টিপে টিপে কচ্ছপের গতিতে একটু একটু করে এগোচ্ছি। শাহজাদা বলেছিল, শেষ কিলোমিটারে মেসেজ দিয়ে জানাতে। ফিনিশিং সময়টুকু ভিডিওতে ধরে রাখার জন্য। মেসেজ পাঠালাম। ফিনিশিং পয়েন্টের কাছাকাছি এসে পতাকা তুলে এগোতে থাকলাম।
ঘড়িতে সকাল সাড়ে নয়টা, দৌড় শুরুর ৮ ঘণ্টা ৩০ মিনিট পেরিয়ে গেছে। ঠিক তখনই বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে ফিনিশ লাইনের ফিতা ছুঁয়ে ফেললাম। সে এক অন্য রকম মুহূর্ত। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, আমার অলস শরীর এমন কঠিন একটি রুট পেরিয়ে ফিনিশ লাইন পর্যন্ত পৌঁছেছে। শাহজাদা বলল, সে ৭ ঘণ্টা ৪৩ মিনিটে সম্পন্ন করেছে। তাকে অভিনন্দন জানিয়ে আয়োজকদের মেডেল গলায় পরলাম।