নকশিকাঁথার মাঠ

নকশিকাঁথার ফোঁড়ের শৈল্পিক কাজছবি: খালেদ সরকার, ছবি কৃতজ্ঞতা: জয়ীতা, দিলশাদ বেগম

নকশিকাঁথার নকশায় জড়িয়ে থাকে অনেক গল্প। এটি একান্তই নারীদের শিল্প। সাধারণত বর্ষাকালে ঘরবন্দী থাকার দীর্ঘ সময়ে নারীরা দল বেঁধে নকশিকাঁথা সেলাইয়ের কাজ করে থাকতেন। হাজারো গল্প তখন ধরা দিত কাঁথার জমিনে রংবেরঙের সুতার কারুকাজে।

“নক্সী-কাঁথাটি বিছাইয়া সাজু সারারাত আঁকে ছবি

ও যেন তাহার গোপন ব্যথার বিরহিয়া এক কবি।”

নক্সী কাঁথার মাঠ—জসীমউদ্‌দীন

কবি জসীমউদ্‌দীন এক অদ্ভুত মায়াময় আখ্যান রচনা করেছিলেন তাঁর পাঠকদের জন্য। সাজু আর রূপাইয়ের বিচ্ছেদি প্রেমের গল্প হলেও সে কাহিনির প্রধান চরিত্র ছিল নকশা তোলা নকশিকাঁথা। কাঁথা বুনতে বুনতে কত কথাই না সাজুর মনে হয়েছে, মনে পড়েছে কত স্মৃতি। লাল-নীল সুতায় সেসব কথাই কাঁথার জমিনে ফুটে উঠেছিল প্রেম আর বিরহ–বেদনার গল্প হয়ে।

নকশিকাঁথার নকশা
নকশিকাঁথায় জড়িয়ে থাকে নানা রকম গল্প

নকশিকাঁথার নকশায় জড়িয়ে থাকে হরেক রকমের গল্প। এটি একান্তই নারীদের শিল্প। সাধারণত বর্ষাকালে ঘরবন্দী থাকার দীর্ঘ সময়ে নারীরা দল বেঁধে নকশিকাঁথা সেলাইয়ের কাজ করে থাকতেন। হাজারো গল্প তখন ধরা দিত কাঁথার জমিনে রংবেরঙের সুতার কারুকাজে। রঙিন সুতায় বোনা এ গল্পের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্বকালে বাংলায় কাঁথার উদ্ভব বলে ধারণা করেন গবেষকেরা। পাণিনির ব্যাকরণ কিংবা অন্যান্য পালি ও সংস্কৃত বইপত্রে, নাথসাহিত্যে, মৈমনসিংহ গীতিকায় কাঁথার উল্লেখ পাওয়া যায়।

কাঁথা দুই রকম

নকশা করা কাঁথাই নকশিকাঁথা। এখানে বলে রাখা ভালো যে কাঁথা দুই রকম। নকশিকাঁথা আর নকশা ছাড়া সাধারণ কাঁথা। যেসব কাঁথায় নকশা থাকে, সেগুলোই নকশিকাঁথা। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নারীরা সেলাই করে চলেছেন এ কাঁথা উষ্ণতা ও উপহারের জন্য। তবে যশোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চল কাঁথার নকশা, সেলাইয়ের ফোঁড়ের কলাকৌশলের জন্য একেবারে স্বতন্ত্র জায়গা তৈরি করে নিয়েছে নকশিকাঁথার ভুবনে। এসব অঞ্চলে নকশিকাঁথার রয়েছে নিজস্ব ঘরানা। দেশ-কাল-পাত্রভেদে কাঁথার নকশার কিছু সর্বজনীন মোটিফ বা প্রতীক থাকে। সেসব মোটিফের বাইরে প্রতিটি অঞ্চলের নকশিকাঁথার নকশায় ভিন্নতা রয়েছে।

একেক জায়গায় একেক নকশিকাঁথা

বগুড়া থেকে শুরু করে কুষ্টিয়া অঞ্চলের নকশিকাঁথা আকারে বেশ বড় এবং মোটা বা পুরু। জ্যামিতিক নকশা ও ফুল, লতাপাতার নকশার ব্যবহার বেশি সে অঞ্চলের নকশিকাঁথায়। যশোর, ফরিদপুর ও খুলনা অঞ্চলের কাঁথা আকারে তেমন বড় নয় এবং কিছুটা পাতলা। এ অঞ্চলের কাঁথার সেলাইয়ের ফোঁড়ে সূক্ষ্মতা রয়েছে। মানুষ ও পশুপাখির নকশা বেশি ব্যবহার করা হয় সে অঞ্চলে। এ রকম আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের নকশিকাঁথায়।

রাজশাহী অঞ্চলের বিখ্যাত কাঁথা হলো লহরি। লহর বা ঢেউ নকশার জন্য এমন নাম। সোজা, কেউটের খুপি, বরফি অথবা তারা ইত্যাদি বিভিন্ন ভাগে বিন্যস্ত থাকে লহরি কাঁথার নকশা। এ নকশাগুলো মূলত ঢেউয়ের বিভিন্ন ধরন। ঢেউখেলানো ফুল ও লতাপাতা দিয়ে লহরি কাঁথার আর একটি ধরন তৈরি করা হয়, যার নাম সুজনি কাঁথা। সুজনি কাঁথা সাধারণত বিছানায় পাতা হয় বা আত্মীয়স্বজনকে বসতে দেওয়া হয়। লহরি, সুজনি কাঁথা, লিক কাঁথা, কার্পেট কাঁথা ও ছোপটানা কাঁথা—এ পাঁচ ধরনের কাঁথা রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে বিখ্যাত। বগুড়া ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের নকশিকাঁথা আকারে বড় ও পুরু, সেলাই তেমন সূক্ষ্ম নয় এবং জ্যামিতিক নকশা ও ফুল, লতাপাতার নকশার ব্যবহার বেশি। অন্যদিকে যশোর, ফরিদপুর ও খুলনা অঞ্চলের কাঁথা আকারে তেমন বড় নয়, পাতলা, সেলাই সূক্ষ্ম এবং মানুষ ও পশুপাখির মোটিফ বেশি ব্যবহার করা হয়।

ময়মনসিংহ অঞ্চলে নকশিকাঁথাকে বলা হয় ‘ফুলের কাঁথা’। খুলনা, যশোর অঞ্চলে নকশিকাঁথার নাম ‘সাজের কাঁথা’। দুই অঞ্চলের এ দুই নাম থেকেই বোঝা যায় সেগুলোর নকশা কী।

ফুলের কাঁথার মূল নকশা বিভিন্ন ধরনের ফুল, বিভিন্ন আকার ও রঙের ফুল। সাধারণত সাদা জমিনে রঙিন সুতায় বোনা হয় এসব ফুল। জ্যামিতিক নকশার খুব একটা উপস্থাপনা নেই এসব কাঁথায়। কিন্তু সাজের কাঁথা অন্য রকম। সাজ মানে সাজানো। সাজের কাঁথার অর্থ হলো দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো কাঁথা। এ কাঁথাগুলোতে ফুল–লতাপাতার বাইরেও রয়েছে বরফির মতো বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা। আর রয়েছে সুতার রঙের খেলা।

রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের নকশিকাঁথায় ফুল, লতাপাতার উপস্থিতি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে রঙিন সুতার কারুকাজ ও জ্যামিতিক নকশার দৃষ্টিনন্দন উপস্থাপনা। এ অঞ্চলের নকশিকাঁথায় বেশির ভাগ সময় পাড়ের দিকে শাড়ির রঙিন পাড় ব্যবহার করা হয় নকশার জন্য। অর্থাৎ শাড়ির রঙিন পাড়ই রেখে দেওয়া হয় কাঁথার পাড় হিসেবে। সে পাড়কে মূল ধরে বোনা হয় বিভিন্ন ধরনের জ্যামিতিক নকশা, যার মধ্যে বরফিই প্রধান। রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের বিখ্যাত তিনটি সেলাইয়ের ফোঁড়ের নাম পখুরি, তারা এবং চেইন। মাছ, পাখি, ফুল, লতাপাতা, বরফি এগুলো সাধারণত তোলা হয় নকশিকাঁথায়।

সুইঁ–সুতার নকশা

ফোঁড়ের রকমফের

রান ফোঁড়, ডবল রান ফোঁড়, ডারনিং ফোঁড়, বেঁকি ফোঁড়, বখেয়া ফোঁড়, বোতামঘর, চেইন ফোঁড়, পখুরি, তারা ফোঁড় ইত্যাদি ফোঁড় বা সেলাইয়ে নকশিকাঁথা বোনা হয়। নকশিকাঁথা সেলাইয়ে এসব ফোঁড়ই মূল। এসব ফোঁড় বা সেলাইয়ের মাধ্যমে কাঁথায় ফুটিয়ে তোলা হয় নকশা। নকশার রকমফের, সেলাইয়ের ফোঁড়ের কলাকৌশল—মূলত এ দুই কারণে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলের নকশিকাঁথার পার্থক্য তৈরি হয়। কাঁথার নকশা কতটা দৃষ্টিনন্দন হবে, কতটা সূক্ষ্ম হবে তা এসব ফোঁড় তোলার দক্ষতার ওপর নির্ভর করবে।

নকশিকাঁথার কাজ ফ্রেমে আটকিয়ে দেয়ালে সাজিয়ে রাখার ধারা জনপ্রিয়

ঐতিহ্যের নকশা

নকশিকাঁথার মূল বিষয় হলো নকশা। এর ঐতিহ্যবাহী নকশা মোটিফের মধ্যে আছে জীবনবৃক্ষ, পদ্ম, সূর্য, চাঁদ, কলকা, স্বস্তিকা, বুটি, মাছ, বিভিন্ন ধরনের ফুল, গরু-ছাগল, ময়ূর, বিভিন্ন ধরনের পাখি, মানুষের অবয়ব, গ্রামীণ জীবনের দৃশ্য ইত্যাদি। বিভিন্ন অঞ্চলে নকশিকাঁথার বিভিন্ন ফোঁড়ে এসব নকশা আঁকা হয়ে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।