বিচিত্র ফুল-ফল-ঔষধি আর শোভাবর্ধনকারী গাছ চারপাশে। সবুজ আর সবুজ। জাতীয় বৃক্ষমেলা ২০১৮ উপলক্ষে চমৎকার এই সবুজের মেলা বসেছে রাজধানী ঢাকার আগারগাঁওয়ের বাণিজ্য মেলার মাঠে। যেখানে প্রতিদিন শুধু ঢাকাবাসী নয়, দূরদূরান্ত থেকে আসা বৃক্ষপ্রেমীর সমাগমও হচ্ছে।
‘সবুজে বাঁচি, সবুজ বাঁচাই, নগর-প্রাণ-প্রকৃতি সাজাই’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে এবার মেলার আয়োজন। মেলার মোট স্টল সংখ্যা ১০১। মেলা চলবে মাসজুড়ে। ১৮ জুলাই শুরু হওয়া মেলা চলবে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত। হাতে সময় নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন একদিন।
মেলায় নতুন যা মিলছে
এবার ডালভর্তি ফলসহ দেশি গাছের সঙ্গে নজরে পড়ছে বিদেশি গাছের উপস্থিতি। রসাল লাল রাসবেরি, কালো ব্ল্যাকবেরি গাছের দাম পড়বে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। উড়িষ্যা থেকে আসা বারোমাসি সাজনা ৬০০ টাকা। ব্রাজিলিয়ান আখ ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। কালো রঙের সুমিষ্ট এই আখ উচ্চতায় ২০ থেকে ৩০ ফুট লম্বা হয়। কিউই ফল, ব্রেড ফ্রুট বা রুটি ফল, কালো আঙুর ২ হাজার টাকা করে। আপেলগাছের দাম ১ হাজার টাকা। পারসিমন, এপ্রিকট, লোকমা ১ হাজার ৫০০ টাকা। স্ট্রবেরি পেয়ারা ১ হাজার ২০০ টাকা। মরু গোলাপ নামে পরিচিত এডোনিয়াম মিলছে ৩০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। এ ছাড়া থাইল্যান্ডের লাল কাঁঠালের কলম চারা পাবেন ১ হাজার টাকার মধ্যে। শিমুল আলু গাছের পাতা অনেকটা শিমুল তুলা গাছের পাতার মতো, তাই লোকে একে তুলাগাছের চারা ভেবে ভুল করে।
চেনা ফল ও ফুল
দেশি গাছের মধ্যে আছে ফলসহ লটকন। ফলসহ পেঁপেগাছের দাম ২ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। আছে তুঁতফলের গাছ, দাম ৩০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা। আনারস, দেশি গাব, বিলেতি গাব—এমনকি বীজ ছাড়া বিলেতি গাবও মিলবে।
শিম, বেগুন, লাউ, কুমড়া, মরিচসহ বিভিন্ন সবজির চারাও বিক্রি হচ্ছে মেলায়। দেখতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় আর খেতে খুব ঝাল- এমন কাঁচা পাকা ঝোপওয়ালা বোম্বাই মরিচের গাছ আছে কিছু দোকানে। হাতের আঙুলের মতো দেখতে ফিঙ্গার লেবুর গাছ। দাম ৫ হাজার টাকার মধ্যে। এ ছাড়া আছে কাগজি লেবু, কলম্বো লেবু, হাজারি লেবু, জারা লেবু, কাঁটাহীন সিলেটি মোম লেবু ও বীজহীন লেবু।
প্রায় প্রতিটা স্টলেই রয়েছে দেশি-বিদেশি নানান রঙের ফুল আর শোভাবর্ধনকারী গাছের উপস্থিতি। ফুলের মধ্যে শীতের ফুল সূর্যমুখী বর্ষায় পাচ্ছেন ৩০০ টাকা মধ্যে। ৩ থেকে ৪ ফুট উচ্চতার কদমগাছ আছে। পাতা ও ফুল আছে আরও। নাইট কুইন পাবেন ১০০ টাকায়। রজনীগন্ধা নিতে পারবেন ৫০ টাকায়। বিভিন্ন রঙের জারবেরা ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। পাতাবাহারের মধ্যে আছে ভেরিগেট চায়না বাঁশ, লাকি ব্যাম্বু। আর ফুলে আছে ভেরিগেট জবা, গন্ধরাজ, কাঠগোলাপের নজরকাড়া রূপ।
হরেক রঙের বাহারি জবা থেকে শুরু করে গোলাপ, রঙ্গন, হাসনাহেনা, মোসেন্ডা, এক থোকা হরেক রঙের লেন্টেনা, বাগানবিলাস, সাদা-হলুদ-খয়েরি আলামন্ডা, দাঁতরাঙা, কাঁটামুকুট, ধবধবে সাদা সুগন্ধি জুঁই, টকটকে লাল-গোলাপি ফুরুস ফুল, কুঞ্জলতা, মর্নিং গ্লোরি, পলাশ, জারবেরা, জিনিয়া, পিস লিলি, কাঁঠালচাপা, চায়নিজ টগর, পুরতলিকা, রজনীগন্ধাসহ আরও অনেক প্রজাতি।
চোখধাঁধানো অর্কিড
মেলার বিশেষ আকর্ষণ মাটি ছাড়া জন্মানো ঝুলন্ত শিকড়সহ দৃষ্টিনন্দন সব দেশি-বিদেশি অর্কিড। গত বছরের তুলনায় এবার অর্কিডের সংগ্রহ বেশি। ফুটন্ত অর্কিডের পাশাপাশি ছোট চারা, এমনকি বোতলবন্দী টিস্যু কালচারের চারাও বিক্রি হচ্ছে মেলায়। মিলবে অর্কিড গাছে দেওয়ার জন্য প্যাকেটজাত সার।
ক্যাকটাস ও বনসাই
লাল ও হলুদ গ্রাফটিং করাসহ মেলায় রয়েছে প্রায় ৫০ প্রজাতির ক্যাকটাস। আকারভেদে ছোটবড় ক্যাকটাস পাওয়া যাচ্ছে ২৫০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায়। একই টবে অনেক প্রজাতির ছোট ছোট ক্যাকটাসের সমন্বয় নিতে পারবেন ১ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে। গত বছর মেলায় আসা সবচেয়ে বড় ক্যাকটাসের নাম ছিল ব্যারেল ক্যাকটাস, যার দাম ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯৯ টাকা! এবার তেমন বড় আকৃতির ক্যাকটাস না থাকলেও একই প্রজাতির ছোট ব্যারেল ক্যাকটাসের দেখা পাবেন মেলায়।
দেশি বট, চায়না বট, চন্দন বট, জিনসেন, কামিনী, নাকাসুয়া অশ্বথ বট, পাকুড় বট, কতবেল, দেবদারু, পলাশ, বাবলা, শেওড়া, নিম, অর্জুন, পাইফোড়, ফাইকাস, মিরিজুয়া, তেঁতুলসহ কত কী বনসাইয়ের দেখা মিলবে মেলায়। প্রকারভেদে এর দাম পড়বে ১ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা।
বরাবরের মতো যা থাকছে মেলায়
মেলায় প্রবেশ করতেই হাতের বাঁয়ে প্রথমে পড়বে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের স্টল। রয়েছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও দুর্লভ সব ফুল-ফল-ঔষধি বৃক্ষ, ক্যাকটাস, অর্কিড আর বনসাইয়ের সমাহার। দুর্লভ ও বিপন্ন প্রজাতির ফল প্রদর্শনীতে রয়েছে—পানাম ফল, রাবার ফল, করবী, কুচিলা, ম্যাগনোলিয়া ফল, বাওবাব ফুল, জারুল ফল, সাইকাস, এরেকা পাম, দেশি গাব, কেয়া ফল, চাল মুগরা, নাগেশ্বর। আছে চালতা, কফি, তমাল, পুন্নাল, কাঁঠাল চাঁপা, বহেরা, গোসৌভিয়া, ডুমুর, দেবদারু, কলকি ফল, মাকাল ফল, গোড়া নিম, আশোক, ডে ফল, নাগলিংগম ফল, পান্থপাদব ইত্যাদি। গাছের মধ্যে আছে ভুঁই কদম, ছাতিম, আগর, শ্বেত চন্দন, বার্মা শিমুল তুলা, ঢোল সমুদ্র, রামধাম চাঁপা, উলট কম্বল, বামন হট্রি, বার্ড নেস্ট, বিষ জারুল, পানবিলাস, নীল চিতা, হলুদ চিতা, লাল চিতাসহ বিচিত্র ও দুর্লভ সব গাছের উপস্থিতি।
বরাবরের মতো এবারও সবচেয়ে নজর কাড়ছে ডালভর্তি একেকটি ফল গাছ। মেলা ঘুরে ঘুরে দর্শনার্থীরা দেখছেন আর বিস্ময়ে অবাক হচ্ছেন, ফলের সঙ্গে সেলফি তুলছেন, আর তাতেও তৃপ্তি না মিটলে কিনে নিচ্ছেন ঝটপট। এমন সব ডালভর্তি ফলের গাছের মধ্যে রয়েছে—আম, জাম, কাঁঠাল, কাঠলিচু, কমলা, নাগপুরি কমলা, মাল্টা, আমলকী, আমড়া, বেল, সফেদা, থাই লম্বাটে সফেদা, থাই লাল শরিফা, থাই ডুমুর, মিসরীয় ডুমুর, থাই ড্রাগন, থাই করমচা, পেয়ারা, আকারে ছোট চায়না লাল পেয়ারা, কুল, ডালিম, আনার, জামরুল, ফিলিপাইনের মিষ্টি চালতা, জাম্বুরা, লেবুসহ রয়েছে শতাধিক জাতের চারা।
বারোমাসি ফলের মধ্যে আম, আতা, আনার, পেঁপে, কলা, বিলম্ব থেকে শুরু করে কলমের বারোমাসি কাঁঠালের চারাও মিলছে মেলায়।
মসলাজাতীয় উদ্ভিদের মধ্যে পাবেন আদা, আম আদা, লেমন গ্রাস, হলুদ, দারুচিনি, ছোট ও বড় এলাচি, তেজপাতা, লবঙ্গ, কারি পাতা, পোলাও পাতা, পুদিনা ইত্যাদি।
ঔষধি বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে অশ্বগন্ধা, সর্পগন্ধা, কালো ধুতুরা, হরীতকী, নিম, নিশিন্দা, পানবাহার, থানকুনি, শালপানি, শতমূলী, লজ্জাবতী, তুলসী, রামতুলসী, সোনালু, কাজুবাদাম, দণ্ডকলস, মটকিলা, হাড়জোড়া, অপরাজিতা, লেমনগ্রাস, ঘৃতকুমারী, নীল, শিবজটা, বড় কালকেসুন্দা, সূর্যকন্যা, নাগমণি, চন্দন, অর্জুন, বাসকসহ বিভিন্ন প্রজাতির চারা।
আরও আছে
শুধু চারাই নয়, চারা লাগানোর বিভিন্ন আকারের বাঁশ-বেত, মাটি ও প্লাস্টিক টবের স্টলও আছে। উপযুক্ত মাটি থেকে শুরু করে মিলছে বিভিন্ন ধরনের জৈব, রাসায়নিক সারসহ ভার্মিকম্পোস্ট বা কেঁচো সার, কীটনাশক, গ্রোথ হরমোন। উন্নত জাতের ফল ও সবজির প্যাকেটজাত বীজও মিলবে। বাগান পরিচর্যার দরকারি সব সরঞ্জামাদি ও কৃষিবিষয়ক বই ও দিকনির্দেশনা মিলবে লিফলেটে। আছে রাবার গাছের তৈরি আসবাবের প্রদর্শনীও। বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্টলে জানতে পারবেন কঞ্চিকলম পদ্ধতিতে বাঁশের চাষ, কাটিং পদ্ধতিতে হাইব্রিড একাশিয়ার বংশবিস্তার সম্পর্কে নানা রকম কৌশল।