
সত্তর কিংবা আশির দশকের মায়েরা সেজেগুজে স্টুডিওতে গিয়ে জুতা-মোজা পরানো পরিপাটি বাচ্চা কোলে নিয়ে ছবি তুলতেন। নবজাতকের ছবি তোলার এই ধরনটাই ছিল বেশি। নব্বইয়ের দশকে অস্ট্রেলীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন আলোকচিত্রী অ্যান গ্যাডেসের তোলা তরমুজের খোলে বসা ছোট্ট শিশুর ছবি বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দেয়। শুভেচ্ছা কার্ড কিংবা ডায়াপারের বিজ্ঞাপন ছাড়াও নবজাতকের ছবি যে শুধু ব্যক্তিগত শখে কয়েক ঘণ্টার আয়োজন করে তুলে রাখা যায়, সে ধারণা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকে। এখন এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে শুধু নবজাতক নয়, মাতৃত্বকালীন সময় থেকেই সুন্দর স্মৃতিগুলো ধরে রাখার চেষ্টা দেখা যায়।

নবজাতকের ছবি তোলার সবচেয়ে ভালো সময় হলো জন্মের ৫ থেকে ১৫ দিন বয়সের মধ্যে। এ সময় বাচ্চা মায়ের গর্ভে যেভাবে হাত-পা গুটিয়ে থাকে, তাই িশশুর ইচ্ছেমতো অঙ্গভঙ্গির ছবি তোলা যায়। নবজাতকের ছবি তোলার দুই রকম পদ্ধতি আছে। স্টুডিও স্টাইল ও লাইফ স্টাইল। লাইফ স্টাইলে বাচ্চার নিজের বাসার সদস্যদের সঙ্গে বাসার মধ্যেই সাধারণভাবে ছবি তোলা হয়। স্টুডিও স্টাইলে রীতিমতো গবেষণা করে, প্রপস বানিয়ে, আয়োজন করে ছবি তোলা যায়।
নবজাতক বা বাচ্চাদের ছবি তোলার সময় আলোকচিত্রী ও শিশুর মা দুজনের মধ্যে সমঝোতা থাকা জরুরি। ফটোসেশনের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই কী ধরনের ছবি তোলা হবে এবং তার জন্য কী কী আনুষঙ্গ দরকার, সেগুলো ঠিক করে ফেলা উচিত। নবজাতকের ছবি তোলায় জামা-কাপড়ের খুব যে দরকার হয়, তা নয়। বিশ্বজুড়ে অনেক ক্ষেত্রেই পোশাক ছাড়া নবজাতকের ছবি তোলার দিকে আগ্রহ বেশি দেখা যায়। তবে এ জন্য সতর্কতার প্রয়োজন আছে। ছবি তোলার ঘরটি যথেষ্ট উষ্ণ না হলে নবজাতকের ঠান্ডা লেগে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রয়োজনে বহনযোগ্য হিটার দিয়ে ঘর গরম রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

শিশুর ডায়াপার, দুধের বোতল, মা ও শিশু দুজনেরই বাড়তি কাপড় থাকতে হবে। আনুষঙ্গ হিসেবে আলোকচিত্রীর কিছু প্রপসের সংগ্রহ থাকা দরকার। যেমন: রিস্ট ব্যান্ড, হেড ব্যান্ড, উলের শাল, টুপি, পশমি কম্বল, বেতের ঝুড়ি, বাচ্চার মাথার ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য বিভিন্ন আকারের কুশন, ওপর থেকে ছবি তোলার জন্য স্টেপিং টুল, ব্যাকড্রপ স্ট্যান্ড ইত্যাদি।
আলোকচিত্রী ইসরাত আমিন তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, ‘প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জিং কাজ নবজাতকের ছবি তোলা। অন্য ছবি তোলার থেকে কয়েক গুণ বেশি প্রস্তুতি থাকতে হয়। অবশ্যই সময় নিয়ে কাজ করতে হবে। দু-তিন ঘণ্টার ফটোসেশন পাঁচ-ছয় ঘণ্টাও লেগে যেতে পারে। শিশু যেকোনো সময় কান্নাকাটি করবে, অস্থির হয়ে উঠবে, খিদে পাবে—এসব কথা মাথায় রেখে সময়ের ব্যাপারে নমনীয় থাকতে হবে। বাচ্চার চোখে সরাসরি আলো ফেলা যাবে না, সে জন্য দরকার বাড়তি আলোর উৎস। ফটোশুটের জায়গাটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাটাও খুব জরুরি।’
ছবি তোলা শুরু করার আগে বাচ্চাকে ভালোমতো খাইয়ে নিতে হবে, যাতে সে বেশ কিছুক্ষণ ঘুমাতে পারে। হালকা গান ছেড়ে দিতে পারেন, ঘুমটা গাঢ় হয়।নবজাতকের ছবি তুলতে সাধারণত তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে। অনিশ্চয়তার বিষয়টা মাথায় রেখে এই কাজ শুরু করতে হবে। শিশু একবার বিরক্ত হলে এরপর তাকে শান্ত করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। নবজাতকের ছবি তোলার সময় স্টুডিও কিংবা ঘরে যথাসম্ভব কম মানুষ থাকা উচিত।
প্রত্যেক শিশুরই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তার নিজস্ব কিছু সৌন্দর্য আছে, হতে পারে সেটা এক জোড়া বড় বড় চোখ, বোঁচা নাক, ফোলা ঠোঁট কিংবা একমাথা ঝাঁকড়া চুল। শিশুর স্বতন্ত্র সৌন্দর্যে নজর দিন। বাচ্চাদের নিজস্ব কিছু আদুরে ভঙ্গিমা তো থাকেই, যার পুরোটাই মায়ায় ভরা আর নিঃসন্দেহে ফটোজেনিক।
ফটোসেশনের সময় বাচ্চাকে নড়াচড়া কিংবা পজিশন করে রাখার সময় সতর্ক থাকুন। জন্মের কয়েক দিন পর্যন্ত বাচ্চার ঘাড়, মাথা খুব নরম থাকে। হাত কিংবা পায়ের ওপর শোয়াতে গেলেও খেয়াল রাখতে হবে খুব। মায়ের সঙ্গে বাচ্চার ছবি তোলার ক্ষেত্রে সচেতন পোজ না দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গি ছবিতে তুলে আনা উচিত। নবজাতকের ছবি তোলার পুরো ব্যবস্থাপনায় যেহেতু মা থাকেন, সেশনের শেষের দিকে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়বেন—এটাই স্বাভাবিক। এ জন্য শুরুতেই যদি মায়ের সঙ্গে ছবিগুলো তুলে রাখা যায়, তবে ভালো।
বাংলাদেশে নবজাতকের ছবি কিংবা হবু মায়ের মাতৃত্বকালীন ছবি তোলার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এই ক্ষেত্রটিতে ছবি তুলতে চর্চা, দক্ষতা আর ধৈর্যের দরকার হয়। শিশুদের ছবি যেসব আলোকচিত্রী তুলছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন ওয়েডিং ডায়েরির প্রীত রেজা, ক্যামেরা গার্লের জোহরা তাবাসসুম, ইসরাত আমিন ফটোগ্রাফির ইসরাত আমিন, রোয়েনা রাসনাত, লেন্স বেবি প্রোডাকশনের তাসনীম মাহজাবীন, বেবি স্টোরির অপূর্ব আবদুল লতিফসহ অনেকেই।
লেখক: প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা, ওয়েডিং ডায়েরি