নাজমা চৌধুরী: কর্মে জীবন ভরা

শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক নাজমা চৌধুরী আর নেই। আজ রোববার সকালে তাঁর মৃত্যু হয়। দেশের নারীশিক্ষা ও নারী অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বিশেষ অবদান রয়েছে নাজমা চৌধুরীর। তাঁর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে ১৯৯৬ সালে দায়িত্ব পালন করেছেন। পেয়েছেন একুশে পদক। নাজমা চৌধুরীর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের নানা দিক নিয়ে ২০১০ সালের ৪ ডিসেম্বর ছুটির দিনেতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

নাজমা চৌধুরী (২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২–৮ আগস্ট ২০২১)
ছবি: ছুটির দিনে

বাড়িতেই ছিল মায়ের লাইব্রেরি। নানা ধরনের বই ছিল তাতে। বইয়ের পোকা ছোট মেয়েটি লুকিয়ে সেসব বই পড়তেন। ম্যাক্সিম গোর্কির মা, শরৎচন্দ্র রচনাসমগ্র থেকে শুরু করে আরও কত কী। বই পড়েই জেনেছেন বেগম রোকেয়ার কথা। ছোট্ট মনে তা ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। ভাবতেন, পর্দাপ্রথার মধ্যে থেকে কত কষ্ট করে লেখাপড়া করেছেন বেগম রোকেয়া। নারীসমাজকে নতুন পথ দেখিয়েছেন। সারা জীবনে এই ভাবনা তাঁকে প্রভাবিত করেছে। আজও তিনি তা ভাবেন। এখনো বারবার পড়েন বেগম রোকেয়ার রচনাসমগ্র। অনুপ্রাণিত হন। সেই আদর্শে তিনিও পথ চলেছেন। নারীর উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। কৃতী সেই মানুষটি হলেন নাজমা চৌধুরী, যাঁর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ।

আরও পড়ুন
ছুটির দিনের প্রচ্ছদে নাজমা চৌধুরী, ২০১০

এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা

পরপর দুই সন্তানের মৃত্যু হয় চৌধুরী ইমামুজ্জামান ও আমিরুন্নেসা খাতুন দম্পতির। আগের দুটি সন্তান ছিল মেয়ে। তাই নাজমা চৌধুরীর জন্মের পর খুশির শেষ ছিল না এই দম্পতির। ১৯৪২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সিলেট শহরে তাঁর নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা চৌধুরী ইমামুজ্জামান পুরকৌশলী ছিলেন। তাঁর ছিল বদলির চাকরি, নানা জায়গায় বাবার সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন। স্কুলজীবন শুরু হয় ভারতের আসামে। সেখানে একটি স্কুলে শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হন নাজমা চৌধুরী। এরপর দেশ ভাগ হয়। ১৯৪৭ সালে চলে আসেন বাবার নতুন কর্মসংস্থল পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায়। তাঁর মা আমিরুন্নেসা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। তবে সাধারণ গৃহিণীদের মতো ছিলেন না। প্রচুর বই পড়তেন। স্কুলের গণ্ডি শেষ হওয়ার আগে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর চৌধুরী ইমামুজ্জামান বাড়িতে গৃহশিক্ষক রেখেছিলেন। আমিরুন্নেসা খাতুন সাহিত্য-সংস্কৃতিমনা ছিলেন। চাইতেন, মেয়ে গান শিখুক। ‘ভালো ফল করতে হবে। তবে তাঁকে অবশ্যই ভালো মানুষ হতে হবে। সেই চেষ্টাই মা করেছেন।’ বললেন নাজমা চৌধুরী। ঢাকায় এসে পুরানা পল্টনের বিদ্যামন্দির স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। পরের বছর আবার তাঁর বাবা বদলি হলেন। এবারের গন্তব্যস্থল রাজশাহী। রাজশাহীর পিএন গার্লস স্কুলে ভর্তি হন চতুর্থ শ্রেণীতে। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া করেছেন। এর মধ্যে তাঁর আরও দুই ভাইবোনের জন্ম হয়। পদ্মাপাড়ের ধারে সরকারি বাসভবনে থাকতেন তাঁরা। প্রায়ই খুনসুটিতে মেতে উঠতেন। তাঁদের বাড়িতে আম, লিচুগাছ ছিল। ফলের মৌসুমে গাছের নিচ দিয়ে হাঁটতে ভালোবাসতেন। তবে রাজশাহীতে থাকাকালের একটি স্মৃতি তাঁর প্রায়ই মনে পড়ে। পঞ্চম কি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়েন। এক ইংরেজ মেয়ের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়েছিল। জেনিফার নামের মেয়েটি পুরোদস্ত্তর ইংরেজ। ছোট্ট নাজমা তখন ইংরেজি বুঝতেন না। বলতেও পারতেন না। ‘জেনিফার যখন রাজশাহী ছেড়ে চলে যান, খুব কেঁদেছিলাম। জানি না, ও কোথায় আছে। কী অদ্ভুত সম্পর্ক ছিল আমাদের।’ বলেন তিনি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম নারী উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ। ১৯৯৬

কৃতিত্বের শুরু

বাবার ফের বদলি। ফিরতে হলো ঢাকায়। ঢাকার কামরুন্নেসা গার্লস স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা (এসএসসি) দিয়েছেন ১৯৫৬ সালে। তাঁর কৃতিত্বের শুরুটা হয় সেখান থেকে। মেধাবী এই মেয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ডের অধীনে মেয়েদের মধ্যে মেধা তালিকায় অষ্টম স্থান অর্জন করেন। এর পেছনে মায়ের অবদান বেশি ছিল। বাবাও সব সময় খেয়াল রাখতেন। পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে প্রশ্নের সঙ্গে উত্তর মিলিয়ে নিতেন। বাবাকে তো বলতে হবে। একবার ফল একটু খারাপ হওয়ায় বাবা তিরস্কার করেছিলেন। শুধু বলেছিলেন, লাবণ্যকে (বাড়িতে সহায়তাকারী মেয়ে) ছাড়িয়ে নাজমাকে বলো সেসব কাজ করতে। খুব কষ্ট পেয়েছিলেন বাবার সেদিনের কথায়। তবে এতে তাঁর লেখাপড়ার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। এর মধ্যে জন্ম হয় তাঁর সবচেয়ে ছোট ভাইটির। হলিক্রস কলেজে ভর্তি হন। যদিও তাঁর ইচ্ছা ছিল ইডেন কলেজে পড়ার। কিন্তু মা-বাবার এই ইচ্ছার মূল্যর জন্য আজ তিনি অনেক কিছু পেয়েছেন। জীবনের শৃঙ্খলাবোধ, মানবিকতা ও নিয়মনীতিটা এখান থেকেই শিখেছিলেন, এখন পর্যন্ত যা তাঁর কাজে লাগছে। তা মেনেও চলেন তিনি। কলেজে জোসেফ বার্নার্ড, হাবিবুল্লাহ বাহার, রোজ মেরী, শামসুন নাহার মাহমুদের মতো শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। ‘মায়ের খুব শখ ছিল আমি গান গাই। কিন্তু আমার কণ্ঠস্বর ভালো ছিল না। তাই হাতে তুলে নিলাম গিটার। গিটার বাজাতে খুবই ভালো লাগত। বাংলাদেশ বেতারেও নিয়মিত গিটার বাজিয়েছি, পরে পিএইচডি করতে যাওয়ায় আর গিটার বাজানো হয়নি। খেলাধুলায়ও ভালো ছিলাম না। বিশেষ করে বস্তাদৌড়ে। আমি তো নড়তেই পারতাম না। মা মাঝেমধ্যে আশপাশের বাসার বাচ্চাদের এনে প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। তখন অবশ্য আমিই প্রথম হতাম। কেননা, ওরা সবাই আমার ছোট ছিল।’ বলেই হেসে ফেলেন নাজমা চৌধুরী। ইস্ট পাকিস্তান হায়ার সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পরীক্ষায় ফের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তিনি এ পরীক্ষায় পুরো বোর্ডের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধা তালিকায় নবম ও মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।

বেইজিংয়ে বিশ্ব নারী সম্মেলনে

কলেজ-জীবন থেকেই ইচ্ছা ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ার, কিন্তু নাজমা চৌধুরীর মা চেয়েছিলেন মেয়ে সাহিত্য নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করবেন। তিনি এ বিষয়ে মেয়ের শিক্ষক শামসুন নাহার মাহমুদের সঙ্গে আলোচনা করলেন। তিনি বলেন, ‘তোমার মেয়ে যা পড়তে চায়, তা-ই পড়তে দাও।’ বেশ তা-ই হলো। অনায়াসে ১৯৫৮ সালে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। তখন দেশের রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল ছিল না। পত্রপত্রিকায় রাজনৈতিক খবরগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। তাই তো শেষ পর্যন্ত নিজের ইচ্ছাতেই এ বিভাগে ভর্তি হওয়া। এখন করতে হবে ভালো ফল। কেননা, পররাষ্ট্রবিষয়ক, কূটনীতিবিদ ও রাষ্ট্রদূত পেশা তাঁকে আকর্ষণ করত। যদিও তখন নারীরা এ পেশায় আসতে পারতেন না। ভালো ফলের মধ্য দিয়ে তিনি এ পেশায় আসতে চেয়েছিলেন। সারাক্ষণ শুধু পড়ার মধ্যে ডুবে থাকা। চেষ্টা-পরিশ্রম বিফলে যায়নি। এমএ পরীক্ষায় যুগ্মভাবে প্রথম হন। তবে এই ভালো ফলের পেছনে যাঁর উৎসাহ ছিল, তিনি হলেন শামসুন নাহার মাহমুদ।

স্বামী মাইনুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে

পরিচয় থেকে পরিণয়

কামরুন্নেসা গার্লস স্কুলের সহপাঠীর ভাই মাইনুর রেজা চৌধুরী। পারিবারিকভাবেও তাঁরা একে অপরকে চিনতেন। সেই সম্পর্ক ঘনীভূত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে এসে। মাইনুর রেজা চৌধুরী তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। ছাত্রাবস্থায়ই পারিবারিক সম্মতিতে ১৯৬১ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। নাজমা চৌধুরীর পথচলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি মাইনুর রেজা চৌধুরীর অনেক সহযোগিতা ছিল। নাজমা চৌধুরী বলেন, ‘সব সময় আমার স্বামী বলতেন, সব সময় আমি তোমার পাশে আছি। পেছন ফিরলেই আমাকে দেখতে পাবে।’ ২০০৪ সালে তিনি মারা যান।

‘এখনো গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয়, তিনি এসেছেন। হয়তো আছেন আমার আশপাশে। সারা জীবনে তাঁর সহযোগিতা না পেলে আমি হয়তো এ অবস্থায় আসতে পারতাম না। সন্তানদেরও প্রতিষ্ঠিত করাতে কষ্টকর হয়ে যেত।’

রাজশাহী পিএন গার্লস স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে

রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ

‘এমএ পরীক্ষার ফল বের হলো। ঠিক সেই সময় হঠাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক দেশের বাইরে চলে গেলেন। পদ শূন্য হলো। আমাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ডেকে পাঠালেন। স্বামী ও মা-বাবা উৎসাহ দিলেন শিক্ষকতা পেশা বেছে নিতে। বাবা যে কী খুশি হয়েছিলেন। সব জায়গায় আমার গল্প করতেন। গর্ববোধ করতেন আমাকে নিয়ে।’ বলেন নাজমা চৌধুরী। কিন্তু শাশুড়ির খুব একটা মত ছিল না। শাশুড়ির মতে, বাড়ির বউ কেন চাকরি করবে? এ সময় নানি-শাশুড়ির (কুমিল্লার শিক্ষাব্রতী নবাব ফয়জুন্নেছার নাতনির নাতনি ছিলেন) জোর সমর্থনে ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনায় যোগ দেন।

কোলজুড়ে আসে প্রথম সন্তান লামিয়া চৌধুরী। নয় মাসের মেয়েকে রেখে কীভাবে পিএইচডি করতে যাবেন? তাঁর মা তাঁকে সাহস জোগালেন। এদিকে স্বামী মাইনুর রেজা চৌধুরীও ব্যারিস্টারি পড়তে যাবেন বিলেতে। তাই স্বামী-স্ত্রী মিলেই পাড়ি জমালেন বিদেশে। কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লন্ডন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ওরিয়েনটেল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পাঁচ বছরে একবার দেশে এসেছিলেন। তবে বিদেশে খুব কষ্ট হয়েছে। নিজের মেয়ের বয়সী কাউকে দেখলেই কান্না পেত। ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে আবার অধ্যাপনায় মন দেন। ১৯৮৪-৮৭ সালে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে নারী উন্নয়ন ও রাজনীতি-সম্পর্কিত কোর্স প্রবর্তন করেন। নারীর বৈষম্যমূলক অবস্থান বিশ্লেষণের উদ্দেশে তিনি এসব বিষয়ে এমফিল ও পিএইচডি গবেষণায় উৎসাহিত করেন। তিনি এ বিষয়ে কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী-সম্পর্কিত গবেষণায় উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সেন্টার ফর উইমেন স্টাডিজ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নেন। এর মধ্যে ১৯৮৮ সালে ফুল ব্রাইট ফেলোশিপের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন মাস ভিজিটিং স্কলার হিসেবে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে তাঁর একটি বিষয় ভালো লেগেছিল। সেখানকার শিক্ষার্থীরা সুশৃঙ্খলভাবে চিন্তা করতে পারেন। বইয়ের ভাষা বলেন না। নিজস্ব চিন্তাচেতনার জায়গাটা বেশ প্রখর। শিক্ষকের সঙ্গেও তাঁদের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। সেখানে কোনো স্বার্থের বাধা নেই।

জন্মদিনে আনন্দঘন মুহূর্তে

তাঁদের নানা প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘এটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ। কেননা সামাজিক, রাজনৈতিক, এমনকি ইতিহাসেও নারীর ভূমিকা সেভাবে প্রস্ফুটিত হতো না। নারীর উন্নয়ন তো জাতীয় উন্নয়নের অংশ। জেন্ডার সেনসিটিভিটি নিয়েও তেমন কাজ হতো না। আমাদের মনে হয়েছিল, শুধু রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাধ্যমে এটি করা সম্ভব নয়। তাই আলাদা একটি বিভাগ চালু করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।’ এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় কতৃ‌র্পক্ষ তাঁকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের পাশাপাশি উইমেন স্টাডিজ বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব দেয়। ২০০৩ সালে তিনি পুরোপুরি উইমেন স্টাডিজ বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে এই বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

বঙ্গভবনে স্বামী, দুই মেয়ে এবং মেয়ে জামাইদের সঙ্গে

বৈচিত্র্যময় কর্মজীবন

বারবারা জে নেলসন তাঁর পত্রবন্ধু। কেউ কাউকে দেখেননি। এরপর দুজন দুজনকে ছবি পাঠান। পরে তাঁদের দেখা হয়। মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে তাঁরা একটি বইয়ের কাজ পুরোদস্ত্তর করেন। ৪৩টি দেশের নারীদের রাজনৈতিক অবস্থান, ক্ষমতায়নের সমীক্ষা তাতে স্থান পায়। ১৯৯৪ সালে বারবারা নেলসন ও নাজমা চৌধুরীর সম্পাদনায় যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত হয় উইমেন অ্যান্ড পলিটিকস ওয়ার্ল্ড ওয়াইড শীর্ষক গবেষণা বই। ‘বেগম রোকেয়ার চিন্তাচেতনা ও বাংলাদেশের নারী আন্দোলন’ বিষয়ে ২০০৩ সালে রোকেয়া মেমোরিয়াল লেকচার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে তিনি বক্তৃতা দেন। এ ছাড়া তাঁর লেখা বিভিন্ন জার্নাল ও বইয়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়।

বেইজিং চতুর্থ বিশ্ব নারী আন্দোলনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবী নারীদের সংগঠিত করা ও ফলাফল অর্জন করতে ১৯৯৩-৯৫ সালে বেসরকারি এনজিও ফোরামের চেয়ার ও সরকারের প্রিপারেটরি কমিটির প্রতিনিধি হিসেবে তিনি যোগ দেন।

পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকারের কর্মপরিকল্পনা তৈরির সার্বিক কাজে নেতৃত্ব দেওয়া, ফলাফল অর্জন করা ও তা বাস্তবায়নের জন্য ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম নারী উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ, শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। তবে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূসের পরামর্শে তিনি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বেশি কাজ করেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেন। ১৯৮০ সালে ইউনেসকোর সম্মেলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ ছাড়া ১৯৮৫ সালে নাইরোবি বিশ্ব নারী সম্মেলনে তিনি প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা রাখেন। নাজমা চৌধুরী বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা এবং আজীবন সদস্য। উইমেন ফর উইমেনের সাবেক সভাপতি, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি।

নাজমা চৌধুরীর সম্পাদিত বই উইমেন অ্যান্ড পলিটিকস ওয়ার্ল্ড ওয়াইড

স্বীকৃতি ও সম্মাননা

২০০৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তাঁকে ‘রোকেয়া চেয়ার’ সম্মাননায় ভূষিত করে। এর আগে ১৯৯৬ সালে গবেষক হিসেবে অন্যান্য শীর্ষ ১০ পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর সম্পাদিত বই উইমেন অ্যান্ড পলিটিকস ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ প্রকাশনা হিসেবে আমেরিকান পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন কতৃ‌র্ক পুরস্কৃত হয়। ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক ‘প্রফেসর ইমেরিটাস’ পদে উন্নীত হন। একই বছর দেশের অন্যতম সম্মানজনক পুরস্কার ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত হন নাজমা চৌধুরী।

জীবন এখন যেমন

গুলশানের বাড়িতে ছোট মেয়ের সঙ্গেই থাকেন তিনি। ছোট মেয়ে বুশরা হাসিনা চৌধুরী ও তাঁর স্বামী মো. ওবায়দুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক। তাঁদের সন্তান আবরাজ ও সানায়াকে ঘিরেই সময় কাটে তাঁর। তাদের দুষ্টুমিতেই তিনি আনন্দ খুঁজে পান। আগে গান শুনতে খুব পছন্দ করতেন। শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় আজকাল তেমন একটা গান শোনা হয়ে ওঠে না। বড় মেয়ে লামিয়া চৌধুরী তাঁর স্বামী-সন্তানসহ কানাডায় থাকেন। জীবনসায়াহ্নে এসে নাজমা চৌধুরী নিজেকে সুখী মনে করেন। তাঁর স্বামী সাবেক প্রধান বিচারপতি মাইনুর রেজা চৌধুরী ও মা-বাবার অনুপ্রেরণা, উৎসাহ ও সহযোগিতায় আজ তিনি মা হিসেবে, নারী হিসেবে ও মানুষ হিসেবে সফল। তিনি চান, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে যেন সহমর্মিতা থাকে। নারীরা যেন তাঁদের আত্মসম্মান বজায় রাখেন। কারও মুখাপেক্ষী না হন।