নারীবান্ধব গবেষণাক্ষেত্র গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন গাউসিয়া

জলবায়ুবিষয়ক সেরা ৬ নারী বিজ্ঞানীদের একজন গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরীছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হওয়ার সময় অনেকেই বলেছিলেন, ‘এই বিভাগে পড়ে কী হবে? কোনো ভবিষ্যৎ নেই তো!’ ঠিক ২২ বছর পর অর্গানাইজেশন ফর উইমেন ইন সায়েন্স ফর দ্য ডেভেলপিং ওয়ার্ল্ডের (ওডব্লিউএসডি) বিবেচনায় ২০২২ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ুবিষয়ক সেরা ছয় নারী বিজ্ঞানীর একজন নির্বাচিত হয়েছেন গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এই ছাত্রী এখন প্রাণিবিদ্যা বিভাগেরই অধ্যাপক। তাঁর আরেক পরিচয় তিনি গবেষক। বিপন্ন প্রাণী ও বিপন্ন জলাশয় সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করেন গাউসিয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির একটি গবেষণা দলেও কাজ করেছেন তিনি।

গবেষণা অনেকের কাছেই রসহীন একঘেয়ে বিষয়। গাউসিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি কিন্তু পুরোপুরি আলাদা। গাউসিয়া বলেন, নতুন কোনো কিছু আবিষ্কার বা উদ্ভাবনের জন্যই তো গবেষণা। তাই গবেষণায় একঘেয়ে লাগার কোনো কারণ নেই। আর তিনি সব সময় সমাধানমূলক গবেষণার চেষ্টা করেন। যেখানে শুধু জার্নালে প্রকাশিত হয়েই শেষ হয় না গবেষণার কাজ; বরং গবেষণায় পাওয়া ফলাফল কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততায় ওই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

উদাহরণ দিয়ে গাউসিয়া বলেন, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির কাজে তাঁরা দেখেছেন, মাছ ধরার জাল প্লাস্টিকদূষণের অন্যতম বড় উৎস। যেখানে-সেখানে ফেলে দেওয়া জালগুলো শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের পানিতে মিশে যায়। দূষণের এই তথ্যই এখন মৎস্যজীবীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। একদিকে তাঁদের যেমন প্লাস্টিকদূষণ সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে, অন্যদিকে জনসাধারণের যুক্ততার মাধ্যমে মাছ ধরার পরিত্যক্ত জাল কীভাবে পুনরায় ব্যবহার করা যায়, সেটিও শেখানো হচ্ছে। ২০১৯-২০ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির ওই গবেষণা প্রকল্পে ৫টি দেশের প্রায় ২০ জন গবেষক ও প্রকৌশলী ছিলেন। বাংলাদেশ থেকে অংশ নেওয়া দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া তিনি দেশের অন্যতম বন্য প্রাণী সংরক্ষণ সংস্থা ‘ওয়াইল্ডটিম’–এর বোর্ড সদস্য।

গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

সারা বিশ্বের মতোই বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও গবেষণা ক্ষেত্রে সাধারণত নারীদের অংশগ্রহণ কম। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম গাউসিয়া। তাঁর মতে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে সম্পদের জটিলতা ও সীমাবদ্ধতা আছে। এ জন্য প্রতিযোগিতাও বেশি। উন্নত দেশে একজন নারী চাইলেই যেমন গবেষণায় পেশা গড়তে পারেন, এ দেশে বিষয়টি অত সহজ না। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে কাজ করার ব্যাপারেও এখানে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আছে। গাউসিয়া বলেন, ‘নারীদের জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তুলনামূলক বেশি। আমি শিক্ষকতা শুরু করেছিলাম নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় বেড়ে উঠেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় মা-বাবা ঢাকার বাইরে যেতে দেবেন না বলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। কিন্তু প্রথম কর্মস্থলই যখন ঢাকার বাইরে হলো, তখন অনেক কষ্টে বাড়ির সবাইকে মানাতে হয়েছে।’

গাউসিয়ার কাছে ভালো ফল আর অধ্যবসায়—এই দুই বিষয় হলো সব প্রতিকূলতাকে জয় করার সহজ মন্ত্র। গাউসিয়া বলেন, অনেক ছাত্রছাত্রীই অভিযোগ করেন, পরিবারের লোকজন তাঁদের ভিন্ন পেশা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দেন না। মা-বাবা তাঁদের একদম বোঝেন না। কিন্তু ভালো ফল আর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অধ্যবসায় দেখলে পরিবারের সবাই নতুন ওই সিদ্ধান্তকেও সমর্থন করবেন বলে বিশ্বাস করেন তিনি।

গাউসিয়া যেমন নিজের মতো করে পরিবারকে বুঝিয়েছেন, তেমনি পরিবারও সব সময় তাঁর পাশে ছিল। তাই সংসার, শিক্ষকতা আর গবেষণা—সবই সমানতালে সামাল দিচ্ছেন তিনি। গাউসিয়ার স্বামী এ এম সাইফুর রহমান ব্যাংকার। তাঁদের একমাত্র মেয়ে আভা ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলের নবম শ্রেণিতে পড়ে। স্বামীও সংসারের অনেক কাজ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। আর মা-বাবা শুরু থেকেই পাশে ছিলেন বলে অনেক কাজ সহজ হয়ে গেছে বলে বিশ্বাস করেন তিনি।

দেশের মানুষের কল্যাণে প্রকৃতি আর পরিবেশ রক্ষা নিয়েই কাজ করে যেতে চান গাউসিয়া। দেশের আরও অনেক নারী গবেষক প্রতিকূলতা ছাপিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের জন্য গবেষণাক্ষেত্রকে নারীবান্ধব করে তোলার স্বপ্ন আছে গাউসিয়ার। যেন পরবর্তী প্রজন্মও গবেষণাকে পেশা করার স্বপ্ন দেখতে পারে।