নারীর চিরায়ত জীবন নিয়ে যে সিনেমা

‘নারী জীবন’ স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির একটি দৃশ্য

চিরদিন মাকে চোখের জল ফেলতে হয়। তাঁর কন্যা যখন মা হন, তাঁকেও ছাড়ে না এই কান্নার বারি। তাঁর কন্যা যখন মা হন, তাঁকেও কাঁদতে হয়। মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে সব মায়েরা চোখের জলে কন্যাদের অন্যের সংসারে পাঠিয়ে দেন। চাইলেও সঙ্গে যেতে পারেন না। তাঁরও থাকে স্বামী–সংসারের পিছুটান। এমনকি স্বামীর মৃত্যুর পরও তাঁর বসতভিটার মায়াজালে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন। বিচ্ছিন্ন হতে পারেন না।

নদীর মতো মমতামাখা একূল-ওকূল দুকূলের মধ্যে মাকে ভাসতে হয়। মায়ের এ কান্না চিরন্তন। তিন প্রজন্মের মায়েদের জীবনের এই অশ্রুকাব্য নিয়ে নারী জীবন নামে নির্মিত একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৯ অর্জন করেছে। গত ১৭ জানুয়ারি প্রদান করা হয়েছে এ পুরস্কার।

নারী জীবন চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (বিএফটিআই)। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক গাজী রাকায়েত। চিত্রনাট্য লিখেছেন রাজশাহী শিল্পকলা একাডেমির সংস্কৃতিবিষয়ক কর্মকর্তা আসাদ সরকার।

স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটির গল্প এ রকম—মা নূরজাহান কান্নাভরা চোখে নদীর দিকে তাকিয়ে আছেন। নৌকায় করে মেয়ে বিউটি যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি। মেয়েকে বিদায় দেওয়ার কান্না তিনি কিছুতেই সংবরণ করতে পারছেন না। আবার তাঁর সোমত্ত মেয়েকে ঘরেও রাখতে পারছেন না। এই মেয়েকে নিজের কাছে রাখার কত চেষ্টাই না করেছেন তিনি। সারাক্ষণ মেয়েকে পাশে রাখার জন্য শেষ পর্যন্ত ঘরজামাইও খুঁজেছিলেন তিনি। মেয়ে বিউটিও অপার মাতৃস্নেহের বন্ধনে পড়ে সায় দিয়েছিলেন মায়ের কথায়। বলেছিল, ‘তুমি আমারে গাঙের জলে ভাসায়ে দিয়েও যদি হাসো, আমি গাঙের জলে ভাসব মা। আমি ভাসব আর তোমার মুখের হাসি দেখে হাসব।’

মা-মেয়ের এমন মধুর সম্পর্কের বন্ধনও শেষ পর্যন্ত তাদের এক ছাদের নিচে ধরে রাখতে পারেনি। কেননা, ঘটকের উদ্দেশে মাকে যখন বলতে শোনা যায়, ‘যে সন্তান মায়ের মুখের হাসির জন্য গাঙের জলে হাসতে হাসতে ভাসতে চায়, তাকে গাঙের জল থেকে রক্ষা করা মায়ের জন্য ফরজ হয়।’ আর তাই হয়তো মা-মেয়ে দুজনের সম্মতিতেও মেলেনি সমাধান। ঘরজামাই রাখার সিদ্ধান্ত নিতে গেলে একদিক মেলে তো আরেক দিক মেলে না। কিছুতেই মা–মেয়ের ইচ্ছা পূরণ হয় না। মেয়েকে বিদায় দিতেই হয়। ঠিক যেমন করে মা নূরজাহান নিজের মাকে ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি আসতে বাধ্য হয়েছিলেন।

ঘটনার পরিক্রমায় একসময় বিউটিকেও মায়ের জায়গায় পাওয়া যায়। মেয়ে ফাহিমাকে কাছে রাখতে তখন মা বিউটিও নিজের মতোই শত চেষ্টা করেন। মাতৃস্নেহের বন্ধন থেকে দূরে থাকতে চাননি ফাহিমাও। তিনি মাকে কাছে রাখার জন্য একটি উপায় বের করেন। প্রস্তাব দেন গ্রাম ছেড়ে মাকে তাঁর সঙ্গে ঢাকা শহরে গিয়ে থাকতে হবে। নিজের মায়ের মতোই বিউটিও এবার দোটানায় পড়েন। স্বামীর ভিটা নাকি মেয়ে, যেকোনো একটি তাঁকে ছাড়তে হবে। ফলাফল চিরায়ত। বিউটিও নিজের মেয়ে ফাহিমাকে তাঁর মায়ের মতোই করেই চোখের জলে বিদায় দেন।

চলচ্চিত্রের গল্প নির্ধারণ প্রসঙ্গে চিত্রনাট্যকার আসাদ সরকারের ভাষ্য হচ্ছে, ‘মায়ের চোখের জল এতটাই শাশ্বত, যা বাতাসের মতো। আমরা বাতাসের মধ্যে থেকেও যেমন বাতাসকে দেখতে পাই না। তেমনি মায়ের চোখের জল আমাদের চোখে পড়ে না। অথচ এ জল মায়ের বুক ভাঙা কান্না থেকে আসে। বিষয়টিকে অনুধাবন করে আমি চলচ্চিত্রে মূর্ত করে তুলতে চেয়েছি।’

গল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় নিয়ে মুম্বাইয়ে অবস্থানরত পরিচালক গাজী রাকায়েতের সঙ্গে ২৩ জানুয়ারি মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘মায়ের পেটে ঝিয়ের (মেয়ের) জন্ম। আজকের মেয়েটি কালকের মা। আবার তার পেটেই মেয়ের জন্ম হয়। মাও নারী, মেয়েও নারী। এই মিলিয়েই নারী জীবন। নারীর চোখের জলের বিষয়টি অকৃত্রিম ও চিরায়ত, তা একজন নারী ছাড়া তাঁর মতো করে কেউ বুঝতে পারেন না। গল্পে এই দিকটি জীবন্ত হয়ে উঠেছে।’ এ বিষয়টি ভালো লাগে গাজী রাকায়েতের। নির্মাণ করেন নারী জীবন চলচ্চিত্রটি। আর সেটিই পেয়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।