নারীর জন্য প্রত্যাশা
>নানা ক্ষেত্রে সাফল্য আর সাহসিকতা ২০১৫ সালে যেমন এসেছে, তেমনি নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে। মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ না ১৬ তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। এখনো অসম মজুরির শিকার নারীরা। এসবের ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে নারীর জন্য কী প্রত্যাশা—তা বলেছেন মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা।

আমরা কি নিজেদের বঞ্চনার কথা বলতে পারছি?
হামিদা হোসেন
মানবাধিকারকর্মী
আমরা যদি ৪০ বছর পেছনে ফিরে তাকাই, অবশ্যই এ সময়ের মধ্যে নারীরা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়েছেন। ১৯৭৫ সালে নারীদের ঘরের বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করতে না বলা হতো। যদিও কৃষি ও হস্তশিল্পে নারীরা পারিবারিক শ্রমিক হিসেবে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতেন। বর্তমানে রপ্তানিশিল্পে ও কৃষিক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু তাঁদের মজুরি কেমন? খুবই কম। অথচ তাঁদের অতিরিক্ত শ্রম দিতে হয় এবং কখনো কখনো অনিরাপদ পরিবেশে অরক্ষিত অবস্থায় তাঁরা কাজ করেন। ২০০৬ সালে বাংলাদেশে যে শ্রম আইন হয়েছে তাতে ঘরের কাজকে শ্রম বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১৮৯তম সুপারিশে যে উপযুক্ত কাজের কথা বলা হয়েছে তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কিন্তু শিক্ষার এই মান কি তাদের অপেক্ষাকৃত ভালো কাজ এবং উন্নততর জীবনের জন্য প্রতিযোগিতা করতে সাহায্য করছে? যদি শিক্ষা নারীকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেই থাকে, তাহলে কেন তাঁদের আমরা বাল্যবিবাহের দিকে ঠেলে দিচ্ছি? কেন তাঁদের স্বনির্ভর হতে সাহায্য করছি না? মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর জন্য সরকারের একটি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব সমনাগরিক হিসেবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতীয় নীতিগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বাংলাদেশের অর্থনীতির সাফল্য নির্ভর করে সস্তায় নারীর শ্রম পাওয়ার ওপর। নারীর কাজ পরিবারের অর্থনীতিকেও টিকিয়ে রাখে। কিন্তু তা কি আমাদের আরও স্বাধীন করছে নাকি আমরা স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির চাহিদা অনুযায়ী যৌতুক দিয়ে যাব এবং অন্যের অধীন হয়েই থাকব? আমরা কি নিজেদের বঞ্চনার কথা নিজেরা বলতে পারছি? নারীদের লড়াই আজ তাঁদের সংসদের আসনে বসাতে পেরেছে। কিন্তু নারীদের বিষয়গুলো কতখানি উত্থাপিত হয়েছে? বীরাঙ্গনারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। কিন্তু এতে নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার অবসান ঘটেনি, না শহরে না গ্রামে।
চাই সাহসী ও প্রতিবাদী নারী
সালমা আলী
নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি
নতুন বছরে পা রেখেছি আমরা অর্থাৎ এগিয়েছি আরও এক ধাপ। তবে সেটা কি সামনের দিকে? এ হিসাব-নিকাশ করার জন্য পেছনে ফিরে দেখাটা আমার কাছে অনেক জরুরি মনে হয়। কারণ, সহিংসতার মাত্রা ও ধরন বিগত বছরের তুলনায় ভিন্নতা নিয়ে সামনে এসেছে। ফলে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ এবং মানবাধিকার রক্ষায় নতুন নতুন সম্ভাবনার পাশাপাশি প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীনও হতে হয়েছে নতুনভাবে। তবে শুধু নতুন সম্ভবনা নয়, সব ক্ষেত্রে নারীর বিচরণ নিরাপদ করতে নারীকে উদ্যোগী এবং সাহসী হতে হবে এই প্রত্যাশা আমি সব সময় করি। ২০১৬ সালেও করছি।

একটি ঘটনা স্মরণ করতে চাই, যা আমাদের প্রত্যাশাকে প্রতিফলিত করেছে। কিন্তু পাশাপাশি তুলে ধরেছে নির্মম বাস্তবতাকেও। লাবণী (ছদ্মনাম) ১৪ বছর বয়সী একজন মেধাবী ছাত্রী। জেএসসি পরীক্ষার ঠিক আগের রাতে এক নরপশুর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়। কিন্তু তার অদম্য মনোবল এবং সাহসিকতার কারণে পরের দিনই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। সে পিছপা হয়নি। ভেঙে পড়েনি। তার সাহসিকতা অনুকরণীয় এটা সত্যি, তবে নারীর প্রতি এ ধরনের সহিংসতার পুনরাবৃত্তি কোনোভাবেই হতে দেওয়া যাবে না।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির বিভিন্ন আইনি সেবাকেন্দ্রে ১৬ হাজার ৩৬৮ জন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু আইনগত সহায়তার জন্য আবেদন করেছেন, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা ও বিচারিক কর্মকর্তার কারিগরি দক্ষতা উন্নয়নে বিশেষত আইটি ফরেনসিক ও সাইবার অপরাধ সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সহিংসতার শিকার নারী ও শিশু যাতে সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিকার ব্যবস্থার চেয়ে প্রতিরোধ কার্যক্রমই বেশি জরুরি।

২০১৬ সালে মেয়েশিশুরা যেন নির্ভয়ে থাকতে পারে
ফারাহ কবির
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের দেশীয় পরিচালক
২০১৫ সালে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলায় সাফল্য, সাত চূড়া বিজয়, লেখাপড়ায় এগিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই নারীর অর্জন ছিল চোখে পড়ার মতো। অর্জনের পাশাপাশি বছরটিতে চিন্তার সময়ও কেটেছে। সরকারের পক্ষ থেকে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ করার চিন্তাভাবনায় মুহূর্তেই সবকিছু ঘুরে যায়। সরকারের এ চিন্তাভাবনার সত্যি সত্যি বাস্তবায়ন ঘটলে নারীর যে অর্জন তা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। তাই বছরটি ভালো-খারাপের মধ্যে মিশ্রভাবে পার হয়েছে। আশা করছি ২০১৬ বছরটি ভালো কাটবে। ২০১৬ সালে মেয়েশিশুরা যেন নির্ভয়ে থাকতে পারে।
অর্থনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য যে পদক্ষেপ তাতে ঘাটতি আছে। ঘরে এবং বাইরে নারীর চলাচল নিরাপদ করতে না পারলে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হবে না। কর্মজীবী যে নারী মা হবেন তাঁর সন্তানকে রাখার জন্য কর্মক্ষেত্রে ক্রেশ থাকতে হবে। রাস্তাঘাটে আলোবাতির ব্যবস্থা করতে হবে। নারীর নিরাপত্তা মানে শুধু যৌন নিরাপত্তার মধ্যে ঘুরপাক খেলে চলবে না। নারীর শারীরিক, মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
নারীর অর্জনকে সামনে এনে রোল মডেল তৈরি করতে হবে। মেয়েশিশুদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নারীর জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবে সবার আগে মনমানসিকতা পাল্টাতে হবে। নারী ও মেয়েশিশুকে মানুষ ভাবতে হবে। সিডওর সংরক্ষিত ধারা দুটো আর দেখতে চাই না। গণমাধ্যমে এখন পর্যন্ত নারীর স্টেরিওটাইপ চিত্রই তুলে ধরা হচ্ছে। সমাজ থেকে নারী-পুরুষে বৈষম্য দূর হচ্ছে না বলেই বিভিন্ন সামাজিক অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে। আশা করছি চলতি বছরে সব ধরনের বৈষম্যের নিরসন হবে।

নারীর কর্মক্ষেত্র হোক বৈষম্যমুক্ত
তানজীব উল আলম
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
কর্মক্ষেত্র, পরিবার, সমাজসহ সব জায়গায় নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। যেন নারীরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। পরিবারেও তাঁদের অবস্থা ভালো নয়। মা, বোন কিংবা বউ যে অবস্থানই হোক না কেন; পরিবারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের মতামতের গুরুত্ব নেই। সামাজিকভাবেও তাঁরা গুরুত্ব পাচ্ছেন না। পারিবারিক ও সামাজিক যে বৈষম্যের শিকার ওনাদের হতে হয়, তা অবস্থানভেদে ভিন্ন হয়।
নারীর প্রতি এ বৈষম্য ২০১৫ কিংবা গত পাঁচ বছরে তৈরি হয়নি। এ অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হয়ে বর্তমান অবস্থানে এসেছে। এটি একদিনে দূর করা সম্ভবও নয়। কিন্তু শুরু তো করতে হবে। সেটি ২০১৬ সালেই হোক। আমি এ বছরে অন্তত একটি পরিবর্তন চাই। নারীদের কর্মক্ষেত্র হোক বৈষম্যমুক্ত। এতে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আরও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি যৌন হয়রানি-সংক্রান্ত একটি নির্দিষ্ট নীতি অবলম্বন করা উচিত প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। এ ব্যাপারে হাইকোর্ট বিভাগের একটি রায় আছে, সে রায়টি যেন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়িত হয়।