নারীর শ্রমে সেমাইয়ের খ্যাতি

চিকন সেমাই রোদে শুকানোর কাজে ব্যস্ত এক নারী কারিগরছবি: তৌহিদ পারভেজ

নারী কারিগরদের পদচারণে সাতসকালেই মুখর হয়ে ওঠে বগুড়ার সেমাইপল্লির শতাধিক কারখানা। তাঁদের কেউ ময়দার খামির বানাতে শুরু করেন, কারও দায়িত্ব পড়ে বিদ্যুৎ বা হস্তচালিত সেমাইকলে খামির ঢালার, কেউবা কলে তৈরি সেমাই রোদে শুকাতে নিয়ে যান, কেউবা ভাজেন কড়াইয়ে। শুকনা সেমাই একসময় খাঁচিতে ভরতে থাকে আরেক দল, কারও দায়িত্ব তখন মোড়ক লাগানোর। নারী কারিগরদের হাতেই এভাবে প্রস্তুত হয় সুস্বাদু চিকন সেমাই।

ঈদুল ফিতরের কয়েক দিন আগে চিকন সেমাই তৈরির এ দৃশ্য দেখে এসেছি বগুড়া শহরের উপকণ্ঠের বেজোড়া, ঘাটপাড়া, শ্যাঁওলাগাতি, কালসিমাটি, শ্যামবাড়িয়া, রবিবাড়িয়াসহ আশপাশের ৮ থেকে ১০টি গ্রামে। এই গ্রামগুলো নিয়ে গড়ে উঠেছে বগুড়ার চিকন সেমাইপল্লি। প্রায় ৫০ বছর ধরে চিকন সেমাই তৈরির কর্মযজ্ঞ এ এলাকায়। এখানকার নারীদের হাতে তৈরি সুস্বাদু সেমাইয়ের খ্যাতি দেশজুড়ে। রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও।

ঈদ উপলক্ষে গড়ে দুই মাস কারখানায় সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়। কারখানায় কাজ করে নারী কারিগরেরা প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করেন

করতোয়া নদীর কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই পল্লিতে চিকন সেমাই তৈরি করেন কয়েক শ নারী। তাঁদের তৈরি সেমাই পাইকারি মোকামে পাঠানো থেকে বাজার ব্যবস্থাপনা দেখভাল করেন কারখানার মালিকেরা। বর্ষাকাল ছাড়া বছরের ৯ মাস এখানকার কারখানায় সেমাই তৈরি হয়। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা সামনে রেখে মাস চারেক সেমাই উৎপাদনের মৌসুম। এ সময় কারিগরদের দম ফেলার ফুরসত থাকে না। তবে করোনাকালে গত বছরের মতো এবারের ঈদেও উৎপাদন কম হয়েছে। আয় কমেছে কারিগরদেরও। অন্য বছর ঈদের দুই মাস কাজ করে মৌসুমি কারিগরেরা গড়ে ২০ হাজার টাকা আয় করতেন। এবার উৎপাদন কম হওয়ায় অর্ধেক শ্রমিককেই বেকার বসে থাকতে হয়েছে। যাঁরা কারখানায় কাজ করেছেন, তাঁরা দুই মাসে গড়ে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা উপার্জন করেছেন।

কারখানার মালিক ও কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দেশভাগের আগে ভারত ও পাকিস্তান থেকে কয়েকজন কারিগর এসে বগুড়া শহরতলির চারমাথা-গোদারপাড়া এলাকায় চিকন সেমাই বানানো শুরু করেন। গোদারপাড়ার কারিগরদের সঙ্গে কাজ করতেন বেজোড়া এলাকার কয়েকজন। এর মধ্যে শ্যাঁওলাগাতি গ্রামের দুলু মিয়া এই এলাকায় প্রথম চিকন সেমাই তৈরি শুরু করেন। তাঁর হাত ধরে এই এলাকার শাহের আলী, খোকা মিয়া, জাবেদ আলীসহ অনেকেই চিকন সেমাই তৈরির পেশায় জড়িয়ে পড়েন। অল্পদিনেই বেজোড়া এলাকা ‘চিকন সেমাইপল্লি’ হিসেবে খ্যাতি পায়।

বেজোড়া গ্রামের একটি সেমাইকলের মালিক মাকসুদা বেগম বলেন, রোজার এক দেড় মাস আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে চিকন সেমাইয়ের ফরমাশ আসতে শুরু করে। ঈদ উপলক্ষে গড়ে দুই মাস কারখানায় সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়। কারখানায় কাজ করে নারী কারিগরেরা প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করেন।

চিকন সেমাই রোদে শুকানোর কাজ করছেন একজন নারী শ্রমিক

অনেক কর্মী কারখানায় কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। করোনায় কাজও হারিয়েছেন অনেকে। কালিসামাটি গ্রামের কারিগর জহুরা বেগম এখনো কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই সন্তান নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। দেড় যুগ আগে চিকন সেমাই কারখানায় কাজ নিই। কাজ করলে মাসে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা আয় হয়। সেই টাকায় দুই ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছি, বসতবাড়ির জায়গা কিনে ঘর তুলেছি।’

বেজোড়ার একটি কারখানার মালিক আবদুর রশিদ বললেন, এ এলাকার দরিদ্র নারীদের মুখে একসময় একবেলা ঠিকমতো ভাত জুটত না, চিকন সেমাই তৈরির কাজ করে তাঁদের অভাব ঘুচেছে।

আর এই নারী কারিগরদের হাতের গুণে তৈরি সেমাইয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে সব জায়গায়।