নিজেকে অনেক একা মনে হয়

অধ্যাপক মেহতাব খানম।
অধ্যাপক মেহতাব খানম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন।—বি. স.

সমস্যা
আমি উচ্চমাধ্যমিকে পড়ি। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। আমার ধারণা, মা-বাবা আমার ছোট দুই ভাইবোনকে বেশি ভালোবাসেন। আমাকে একদমই ভালোবাসেন না। এমন নেতিবাচক মনোভাব আমাকে দিনের পর দিন তিলে তিলে ধ্বংস করছে। আমি দীর্ঘদিন ধরে বিষণ্নতায় ভুগছি। বোনের সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য বেশি নয়। মা-বাবা কথায় ও কাজে এমন আচরণ করেন, মনে হয় যেন তাঁদের দুটোই সন্তান; আমি কেউ নই। খুব কষ্ট হয়। অনেকবার ভেবেছি, তাঁদের খুলে বলব এমন আচরণ আমার ওপর কতটা প্রভাব ফেলছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত বলা হয়নি।
সম্প্রতি ছেলেবন্ধু আমাকে ছেড়ে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে নিজেকে অনেক একা মনে হয়। আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না, আমি জীবনে উন্নতি করতে পারব না, আমাকে কারও প্রয়োজন নেই, আমি চলে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, সবাই খুশি হবে—এমন সব চিন্তা মাথায় ঘুরঘুর করে। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে নিজের মনকে শান্ত করতে পারি? যাঁদের ব্যবহারে আমি কষ্ট পেয়েছি ও পাচ্ছি, তাঁদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা উচিত? কীভাবে উদ্বেগ কমিয়ে ইতিবাচক চিন্তা করা যায়?
নাম ও ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ
এটি অত্যন্ত দুঃখজনক যে তুমি নিজের পরিবারের মধ্যেই এভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছ। তুমি কি বুঝতে পেরেছ, তাঁরা কী কারণে তোমার সঙ্গে এই নেতিবাচক আচরণগুলো করছেন? তোমার মা কি খুব অল্প বয়সেই তোমাকে জন্ম দিয়েছেন? বাবা-মায়ের পারস্পরিক সম্পর্কটা কি যথেষ্ট শ্রদ্ধাপূর্ণ? অনেক সময় দেখা যায়, বিয়ের পর যখন স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ক চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে যায়, তখন বড় সন্তানটি সবচেয়ে বেশি অবহেলিত হয়। প্রতিনিয়ত তাঁদের রোষের কবলেও পড়ে যায়। সময়ের সঙ্গে দম্পতিরা পরস্পরের নেতিবাচক দিকগুলোর সঙ্গে কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে পড়েন বলে পরবর্তী সন্তানদের এ ধরনের পরিস্থিতি ততটা মোকাবিলা করতে হয় না। তুমি যখন বুঝতে পেরেছ তাঁরা তোমার প্রতি স্নেহপ্রবণ নন, তখন হয়তো নিজেকে আরও দূরে সরিয়ে রেখেছ। যদি তাঁরা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-কষ্টের জন্য তোমার প্রতি অবিচার করে থাকেন, তাহলে সেখানে নিজেকে একেবারেই ছোট ভাবার কোনো কারণ নেই।
তুমি যেহেতু অনেক দিন ধরেই বিষণ্নতায় ভুগছ, হয়তো বা সে কারণেই অবচেতনভাবে অন্য একটি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে নিজেকে ভালো রাখার প্রয়াস করেছ। তবে তোমার ভেতরে যে পরিমাণ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার ক্ষুধা ছিল, ছেলেবন্ধুটি সেটি পূরণ করতে সমর্থ হয়নি। এতে করে তুমি আরও হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছ।
আমাদের ভেতরে যখন শূন্যতা থাকে, তখন কোনো সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। নতুন সম্পর্কগুলো সফলভাবে চালিয়ে যাওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়ে। ছেলেবন্ধুটির ওপরে তুমি অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলে বলে তার চলে যাওয়া তোমাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। এ কারণেই জীবনের প্রতি ও নিজের প্রতি তুমি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছ। যাঁদের আচরণে তুমি কষ্ট পেয়েছ, তাঁদের সম্ভব হলে বলো, শৈশব থেকেই তুমি কী কী কারণে কষ্ট পেয়েছ এবং কিছু প্রকাশও করতে পারোনি। তাঁরা যা করেছেন, এর পরিবর্তে কী করলে তোমার নিজেকে গ্রহণযোগ্য ও¯ স্নেহের পাত্র বলে মনে হতো, তা-ও উল্লেখ করতে পারো। যদি মুখে বলতে তোমার খুব সংকোচ বোধ হয়, তাহলে চিঠি লিখে কথাগুলো বলো। তাঁদের কোনো রকম দোষারোপ না করে, তোমার পর্যবেক্ষণ ও অনুভূতির কথাগুলোই ব্যক্ত করো। তাঁদের অনুরোধ জানাও, তোমাকে মানসিকভাবে একটু ভালো থাকতে তাঁরা যেন সহায়তা করেন।
যদি এই বিষণ্নতা চলতেই থাকে, তাহলে কোনো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মনোবিজ্ঞানীর কাছে যেতে পারো। প্রয়োজনে তিনি তোমাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছেও পাঠাতে পারেন।