
চলার পথে আমাদের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। সবার ভেতরে কমবেশি দোষ ও গুণ থাকে। অনেক সময় এসব দোষের কারণে মানুষের ভেতর ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। সেটা ব্যাপক আকার ধারণ করে। এতে করে মানুষের ভেতর দূরত্ব সৃষ্টি হয়, সেটা যেকোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রেই হতে পারে। ঠিক এ রকমই একটা ব্যাপার বা দোষ অনেকের ভেতর দেখা যায়, তা হলো নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানোর প্রবণতা। এই প্রবণতা থাকার ফলে সেই মানুষটির আশপাশের মানুষের সঙ্গে চরম ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়, এমনকি অনেক সময় সম্পর্ক ছিন্নও হয়ে যায়।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর এই ব্যাপারটাকে সাইকোলজিক্যাল ডিফেন্স মেকানিজমের একটা অংশ বলা হয়। যাঁরা এই কাজটি করেন, মূলত অবচেতন মনেই তা করেন। এর কারণ হতে পারে অনেকে নিজের ত্রুটি দেখতে পারেন না। তাঁদের ভেতর একধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়, তার নিজেরও কোনো ভুল হতে পারে বা থাকতে পারে-এ ব্যাপারটা একেবারেই সহজভাবে মানতে পারেন না। তিনি যখন ভুলটা করেন এবং ভুলটা সামনে চলে আসে, তখন তিনি ব্যাপারটা গ্রহণ করতে পারেন না। ভুলটা কমিয়ে ফেলার জন্যই অবচেতন মনে অন্যের ঘাড়ে দোষটা চাপিয়ে দেন এবং নিজেকে মুক্ত মনে করেন।
এ ব্যাপারটা মূলত তাঁদের ভেতরেই বেশি দেখা দেয়, যাঁদের ভেতরে খাপ খাওয়ানোর অথবা মানিয়ে চলার অভ্যাস কম। এমনটাই মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোবিজ্ঞানী মেখলা সরকার। মনে রাখতে হবে, মানুষ হলে ভুল হতে পারে, সেটা মেনে নিলেই ভুলটা শোধরানোর সুযোগ থাকে সেখানে। কিন্তু ভুলটা যদি আমরা মানতেই না পারি বা স্বীকার না করি এবং অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিই, তাহলে সেখানে আর শোধরানোর সুযোগ থাকে না। এর ফলে কর্মজীবনে হোক বা পরিবারের ভেতরে হোক, দূরত্বের সৃষ্টি হয়, তিক্ততা বেড়ে যায় এবং সম্মানের জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়।
অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর ফলে যাঁর ওপরে দোষটা চাপানো হয়, তাঁকে একধরনের অস্বস্তিতে ফেলা হয়। বিনা কারণে তাঁর প্রতি অন্যায় করা হয়। নিজে ছোট হওয়া থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য অন্যকে ছোট করা হচ্ছে। কেউ যদি একবার অন্যের ওপর দোষ চাপাতে থাকেন, তখন তিনি আর নিজের ভুল বুঝতে পারেন না এবং ক্রমাগত একই কাজ বারবার করতে থাকেন। এ ব্যাপারটা থেকে উত্তরণের সহজ পথ বেছে নিতে হবে।
ছোটবেলার কথাই ধরা যাক, অনেক অভিভাবকের ভেতরে একটা প্রবণতা থাকে, তা হলো নিজের সন্তানের কোনো দোষ বা ত্রুটি তাঁরা সহজে মেনে নিতে পারেন না, মেনে নিতে চান না। হয়তো ভুলটা নিজের সন্তানই করেছে, এ ক্ষেত্রে হয় তিনি দোষটা চেপে যান, নয়তো অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। বাচ্চাদের ছোটবেলায় যে শিক্ষা দেওয়া হবে, তারা বড় হয়ে তা-ই গ্রহণ করবে। তাদের ভেতরে সেসব প্রবণতাই দেখা যাবে। কিন্তু শৈশবকালেই যদি বাচ্চারা কোনো ভুল করে, তাদের যদি ভুলটা ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং শোধরানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়, তবে তারা ভালো শিক্ষাটাই গ্রহণ করবে। নিজের ভুল বুঝতে পারার শিক্ষাটা গ্রহণ করবে। যেকোনো ক্ষেত্রেই নিজে এই ব্যাপারটা অনুভব করতে হবে যে ভুলত্রুটি যে কারও হতে পারে। সেটা স্বীকার করে নিলে শুধরে নেওয়াটা সহজ হবে। নিজের ভেতরেও একধরনের ভালো লাগার ব্যাপার কাজ করবে এবং এতে করে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাটা বেড়ে যাবে।
গ্রন্থনা: ফারজানা জামান