
বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। কেউ ভুল করলে তা স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে দুর্বলতা খুঁজে পান না। আবার অনেকেই মনে করেন ভুল করেছি তাতে কি; বরং স্বীকার করলে দুর্বলতাই প্রকাশ করা হলো। যুক্তি তোলেন বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে ভুল স্বীকার করা মানেই দুর্বলতা, এমন একটি ধারণা জনসমাজে প্রচলিত।
আবার কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়ার উদাহরণ মহান নেতার সদ্গুণ। জার্নাল অব বিজনেস ইথিকস-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, অন্তর থেকে ক্ষমাপ্রার্থনা বিনয়ের প্রকাশ হলেও বিশেষ করে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে, গবেষকেরা মনে করেন, এমন ভুল স্বীকার করা দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য খুব প্রয়োজনীয়।
গবেষকেরা বলেন, এমন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন মা-বাবা, অফিসপ্রধান, অধ্যক্ষ, বড় কর্মকর্তা পর্যন্ত অনেকেই। আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়া সদ্গুণ, একজন গবেষক বলেছেন, ব্যবসায়ে শীর্ষ ব্যক্তিদের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে আন্তরিকভাবে ভুল স্বীকারে উদ্যোগী হওয়া যায়, এ জন্য রয়েছে চারটি যুক্তি।
* কেউ আপনার ব্যবহারে বা কর্মে আহত হলে তাঁদের চিহ্নিত করা এবং তাঁদের আঘাতে সমব্যথি হওয়া।
* এমন ঘটনার জন্য পুরো দায়দায়িত্ব নিজে নেওয়া। আমরা বক্তৃতায় বলি, ‘কৃতিত্ব সব আপনাদের, ব্যর্থতা যা তার দায় আমার।’ কিন্তু সত্যি তা আমরা মন থেকে কজন বলি?
* নিঃশর্তভাবে বলা যে ‘আমি সত্যি দুঃখিত।’
* যা গোলমাল হলে একে স্তম্ভিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা। হয়তো আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থনার শেষে বলা যায়, ‘আমি আর কী করতে পারি আপনার জন্য।’
ব্যক্তিপর্যায়ে এমন উপদেশ দেওয়া সহজ কিন্তু নিজের জীবনযাপনের প্রকাশ ঘটানো এত সহজ নয়। তবে এমন প্রকাশ ঘটানো যে মূল্যবান, সম্পর্ক স্থাপনে তা অনস্বীকার্য। আর ক্ষমাপ্রার্থনার অনুভব যদি অতিরিক্ত হয় তাহলে এমন ঘটনা অন্যের জীবনে ঘটানোর আগে আমরা অনেকবার চিন্তা করব তো বটেই।
আবার অনেকের মতে, আন্তরিকভাবে ভুল স্বীকার করা শক্তিমানকেই সাজে। সরল ব্যক্তিরাই তা করতে সমর্থ হন।
সমাজে যদি অনুতাপ, ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা শক্তিমানেরা করতেন, তাহলে কী যে ভালো হতো। তবে অনেক দেশে তারকারা ও রাজনীতিবিদেরা এমন ক্ষমা ও অনুতাপ প্রকাশ করলে তা কতটুকু আন্তরিক—এ নিয়ে সন্দেহ করছেন বিজ্ঞজনেরা। ক্ষমা চাওয়ার নানা উপায় তো আছে। চলুক, চলুন এমন উপায়। ‘আমি দুঃখিত’ এমন বলে পাশ কাটানো। অনেক সময় সভা-সমিতি-আলোচনায় একজনের ভুল বের করাও অনেকের আনন্দ দেয়। তাই ক্ষমা চেয়ে দুর্বলতা প্রকাশে অনেকে রাজি হন না। তবে একটি কথা ঠিক, আমরা যাঁকে বা যাঁদের নেতা মানি, তাঁরা যদি নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত না হন, অন্তত ক্ষমাপ্রার্থনা না করেন, তাহলে সেই নেতার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ থাকে না।
আমার বন্ধু যদি বলে, ‘দেখ, আমি কী যে ভেবেছি, ভুল ভেবেছি, জানিস। খুব দুঃখিত রে এ জন্য।’ ‘আমার তখন মনে হয়, বন্ধুটি তার ভুল বুঝতে পেরেছে। তার ভুল ধারণার অবসান ঘটেছে। তখন নিজেকে অনেক নিরাপদ মনে হয়।’
কোথায় একটি উদ্ধৃতি পড়েছিলাম, ‘সুখী হতে চাইলে অপ্রয়োজনীয় অনেক কিছুই ভুলে যেতে হয়। হতে হয় ক্ষমা করার মতো মহান হৃদয়ের অধিকারী।’
ক্ষমা যেমন চাইতে হয়, তেমনি ক্ষমা করে দেওয়াও মহৎ গুণ।
দাম্পত্য জীবনে এটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। জীবনসঙ্গী যদি ভুল করে আর সে জন্য হয় অনুতপ্ত, ক্ষমা চায়, দুঃখিত বলে; তখন মনের কালো মেঘ উড়ে যায়, আবার যুগল জীবনে ফিরে আসে শান্তি ও আনন্দ।
সবচেয়ে উদ্বিগ্ন হই যখন দেখি, বন্ধু বা সহকর্মী ভুল সিদ্ধান্ত হয়তো নিল এবং তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে বা ভুল প্রমাণিত হলেও একে এড়িয়ে যায়, স্বীকার না করেই। নিজের ভঙ্গুর অহংবোধকে রক্ষা করার জন্য হোক বা ভুল থেকে শিক্ষা না নেওয়ার প্রবণতা থেকে হোক, এমন ঘটনা দেখতে বেশ কষ্ট হয়।
নিজে ভুল করলে বা ভুল সিদ্ধান্ত নিলে, ভুল স্বীকার করাকে দুর্বলতার প্রকাশ মনে হতে পারে। অথচ ব্যাপারটি উল্টো। ভুল, অন্তর দিয়ে স্বীকার করা, মহত্ত্বের প্রকাশ, একটি সদ্গুণ, নিজের ভেতরের সংহতি ও শক্তির প্রকাশ। বিপদে, বিপর্যয়ে, দুঃসময়ে নিজের গুণের প্রকাশ ঘটানো বরং মহৎ গুণ। একজন নেতার মধ্যে নিজের ভুল স্বীকার করার মতো শক্তি, বিশ্বাস ও সচেতনতা থাকা মহত্ত্বের লক্ষণ। কজনেরই বা তা থাকে? আমরা নিজেরাও একে চর্চা করে দেখি না কেন? খুব অনুপ্রেরণার কাজ হবে এটি।
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা