নিঝুম দ্বীপের জঙ্গলে
আমরা ভেবেছিলাম, জাগতিক সব দুঃখ-দুর্দশা ভুলে গিয়ে রাজকুমার সিদ্ধার্থের মতো গৃহত্যাগ করব। কিন্তু বিশ্বে সবার সমস্যা থাকলেও সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের সমস্যাগুলো হয় আমাদের। এডিস গোত্রের এক মশার কামড়ে সিমু ভাইয়ের হলো ডেঙ্গু। জুনায়েদ ভাইয়ের গায়েহলুদ অবস্থা—মানে জন্ডিস। সেই জন্ডিসও ভয়াবহ! বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল বিলিরুবিন। সৈয়দ রাকিব ভাই সদ্য বিয়ে করেছেন; তিনি সব মিলিয়ে দুটো জায়গায় যান—অফিস আর শ্বশুরবাড়ি। ঈদের ছুটিতে অফিস বন্ধ, শ্বশুরবাড়ি তো আর বন্ধ না। তাই আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, তিনি শ্বশুরবাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও যাবেন না। আসিফ মেহ্দী ভাইয়ের সমস্যা আরও গুরুতর। ছুটিতেও বাসায় বসে অফিসের টেনশন—এই বুঝি ‘অন কল’ এল। তা ছাড়া সামনে বিসিএস। তিনি দিন-রাত পড়ালেখা আর ছড়া লেখা নিয়ে ব্যস্ত। আর বর্ষা আপু তো বলেই দিয়েছেন, সাগর, পাহাড়, দেশ, বিদেশ—যেখানেই যাই, তাঁর কোনো আপত্তি নেই। শুধু রাত আটটার মধ্যে তাঁকে বাসায় ফিরতে হবে!এত সমস্যা দেখে আমি আর পাভেল ভাবলাম, মনের দুঃখে জঙ্গলে যাব। কিন্তু ঢাকা শহরে জঙ্গলও নেই। কী আর করা, আমরা গেলাম হাতিরঝিল। তখন মনে হলো, শুধু কিশোর ভাইয়েরই কোনো সমস্যা নেই। গ্রামের বাড়ি হাতিয়ায় গিয়ে নিশ্চিন্তে মজার খাবার খেয়ে ‘ইটিং চিতই পিঠা’ টাইপ স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। কিন্তু আমরা গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক। কেউ সমস্যায় থাকবে, কেউ থাকবে না—তা হতে পারে না। কিশোর ভাইয়েরও কিছু সমস্যা মোকাবিলা করা উচিত। তাই আমরা তাঁর গ্রামের বাড়ি হাতিয়া হয়ে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এতে কিশোর ভাইয়েরও সমস্যা হবে, আমাদের মনের দুঃখে নিঝুম দ্বীপের জঙ্গলেও যাওয়া হবে।শুনলাম, রস+আলোর অনিয়মিত লেখক নওরোজ ইমতিয়াজও দলবল নিয়ে নিঝুম দ্বীপ যাচ্ছেন। আমরা চামে তাঁদের দলে ভিড়ে গেলাম। আমাদের সঙ্গে আরও যোগ দিলেন বয়সে ছোট, কিন্তু আকৃতিতে বড় রেদওয়ান রিদন, সাজু ভাই ও হাসান ভাই। সাজু ভাইয়ের বিশাল ব্যাগে একটাই জিনিস—লাইফ জ্যাকেট। লঞ্চ যদি ডুবে যায়, সে জন্য। আমি অবাক! এই লাইফ জ্যাকেটে কি এত বড় লঞ্চ বাঁচবে? পরে বুঝলাম, এটা লঞ্চ বাঁচাতে নয়, সাজু ভাইকে বাঁচাতে আনা হয়েছে। গত শীতে আমরা সবাই যখন উলের জ্যাকেট কিনছিলাম, সাজু ভাই তখনই বুদ্ধি করে একটা লাইফ জ্যাকেট কিনে ফেলেছিলেন। সেটা এখন শীত-বর্ষা সব সময় ভালো সেবা দিচ্ছে। কিন্তু লঞ্চের কেবিনে ঢুকে দেখি, দুটো লাইফ জ্যাকেট সাজানো আছে!নির্ধারিত সময়ে লঞ্চ ছাড়ল। লক্ষ করলাম, বুড়িগঙ্গার পানি কীভাবে যেন পরিষ্কার হয়ে গেছে। ভাবছিলাম ‘বুড়িগঙ্গা বাঁচাও’ টাইপ সংস্থাগুলো এখন কী করবে? তখনই দেখলাম, লঞ্চের যাত্রীরা অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে নদীতে চিপসের প্যাকেট, জুসের বোতল ফেলছেন। বুড়িগঙ্গা যে খুব সহজে দূষণমুক্ত হচ্ছে না—এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।রাতের খাবার শেষে শুরু হলো গানের আসর। একের পর এক গান শোনালেন নওরোজ ভাই। সংগীতের সব শাখাতেই তাঁর অবাধ বিচরণ। ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, ভক্তিমূলক, আধুনিক, উচ্চাঙ্গ ইত্যাদি যত ধরনের গান আছে, সবই গাইলেন তিনি। ভেবেছিলাম, নওরোজ ভাইয়ের বড় পরিচয় তিনি স্বর্ণা আপুর স্বামী; তা ছাড়া লেখক, টিভি-ব্যক্তিত্ব, আরও অনেক কিছু। কিন্তু তাঁর সংগীতপ্রতিভা দেখে মনে মনে আমি তাঁকে লঞ্চের ‘গানম্যান’ উপাধি দিলাম।হাতিয়ায় ল্যান্ড করলাম সকালে। কিশোর ভাইয়ের বাড়িতে খাদ্যময় দিন পার করে চলে গেলাম নিঝুম দ্বীপ। এক ছেলে এসে বলল, ‘আপনারা ফড়িং দেখতে আইছেন, তাই না?’ বেশ অপমানিত বোধ করলাম। এই ছেলে কী ভেবেছে? শহরে থাকি বলে কি আমি জীবনে ফড়িং দেখিনি? কত ফড়িং ধরে ধরে...পরে বুঝলাম সে আসলে হরিণকে ‘ফরিণ’ বলেছে। দ্বীপের সবাই হরিণকে বলে ফরিণ।পরদিন সকাল। আমরা ফরিণ দেখতে জঙ্গলে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে দেখি, ঘাটের পাশে একটা হরিণ ঘাস খাচ্ছে। পাত্তাই দিলাম না। একটা হরিণ কী দেখব? জঙ্গলে যাচ্ছি শত শত হরিণ দেখতে। নৌকায় উঠলাম। নদীতে তখন ভাটা। দুই মাঝি বইঠা বাইছে। হঠাৎ শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। দমকা বাতাসে নৌকা দুলছে। শক্ত করে নৌকা ধরে বসে আছি। নৌকা উল্টে নদীতে পড়ে গেলে আর রক্ষা নেই—এই যখন সবার ভাবনা, তখন দেখি চারটা গরু হেঁটে হেঁটে নদী পার হচ্ছে। আমরা বিস্মিত। মাঝনদীতে গরু হাঁটছে! মানে কী? একটু পর দেখি, আমাদের মাঝিও লাফ দিয়ে নদীতে নেমে নৌকা ঠেলা শুরু করেছে! তখন বুঝলাম, এটা আসলে ‘পার হয়ে যায় গরু’ টাইপ নদী। ভাটার সময় হাঁটা যায়।আমরা চলে গেলাম গভীর জঙ্গলে। সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ বন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, পা দেবে যাওয়া কাদা, শ্বাসমূল! ঠিকভাবে হাঁটাই যায় না। জোঁকের কথা তুলতেই কিশোর ভাই জোঁক ভেবে হেসে উড়িয়ে দিলেন, ‘ব্যাটা বেকুব, লোনা পানিতে জোঁক থাকে নাকি?’ কী অদ্ভুত! এটা যে লোনা পানি তা তো আপনি জানেন, জোঁক কীভাবে জানবে? যা-ই হোক, আমরা নিঃশব্দে হাঁটছি। শব্দ হলে হরিণের পাল পালিয়ে যাবে। একটু পর পর কাদায় আমার স্যান্ডেল আটকে যাচ্ছে। মূল দল থেকে আমরা তখন অনেকটাই পেছনে। হঠাৎ কিশোর ভাই ইশারা করলেন, হরিণের পাল দেখা গেছে। দ্রুত হেঁটে গেলাম। কোমরপানির খাল অনায়াসে পার হয়ে যেই সামনে যাব, এমন সময় নীরব জঙ্গলে বিকট শব্দে আমার মুঠোফোনের রিংটোন বেজে উঠল। বৃষ্টির কারণে মুঠোফোন পলিথিনে ভরে ব্যাগে রেখেছিলাম, সাইলেন্ট করব, সে উপায় নেই। দ্রুত কিশোর ভাইদের কাছে এসে শুনি, হরিণের দল পালিয়ে গেছে। বুঝলাম, প্রযুক্তি আমাদের দিয়েছে অনেক, কিন্তু কেড়েছে তার চেয়েও বেশি। আরও এক ঘণ্টা কর্দমাক্ত পথে হাঁটলাম, হরিণের দেখা নেই। শেষে নৌকার কাছে ফিরে যাওয়ার পথে দেখি একটা গরু ঘাস খাচ্ছে। হায় রে কপাল, দেখতে এলাম হরিণ, দেখলাম গরু! মনে হলো গরুটাও অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, ‘এত কষ্ট করে আমাকে দেখতে এসেছে, এরা গরু নাকি?’ মনের দুঃখে আবার দ্বীপে এসে দেখি, সকালের সেই ঘাস খাওয়া হরিণটাও নেই আশপাশে।ধুর, জঙ্গলেও শান্তি নেই।