নির্যাতনে বিপন্ন নিরাপদ মাতৃত্ব

নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত হলে মা ও শিশুর মৃতু্যঝুঁকি কমে যায়
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত হলে মা ও শিশুর মৃতু্যঝুঁকি কমে যায়

নিরা (ছদ্মনাম) (২৫) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি শয্যায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। একটু পরপর যন্ত্রণায় মুখ বেঁকে যাচ্ছে। তাঁর পাঁচ মাসের গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে গেছে। শারীরিক কোনো অসুস্থতার কারণে নয়, স্বামীর নির্যাতনে। পাশে বসে অঝোরে চোখের পানি ফেলছেন নিরার পঞ্চাশোর্ধ্ব মা।নিরাপদ মাতৃত্ব হচ্ছে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে একজন নারী তাঁর নিজ সিদ্ধান্তে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর গর্ভ ও প্রসবসংক্রান্ত জটিলতা ও মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব সেবা নিশ্চিতভাবে পেতে পারেন। কিন্তু স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নির্যাতনে বহু নারী এ সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। তাঁরা গর্ভবতী মাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেন। এতে গর্ভপাতসহ প্রসবকালীন নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। এমনকি গর্ভপাতের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরের নারীই এ সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, বিঘ্নিত হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব। অচেতন অবস্থায় ১৩ মে সকালে নিরাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নিরার গর্ভপাত হওয়ার পেছনের কাহিনি বলেন তাঁর মা, ‘দুই বছর আগে আমাদের পছন্দেই নিরার বিয়ে হয়। মাস ছয়েক যেতেই শুরু হয় জামাইয়ের বায়না। আজ এটা দিতে হবে তো কাল ওটা। প্রথম দিকে তার চাহিদা পূরণ করা হলেও গত বছর থেকে বেঁকে বসে নিরা। জামাইয়ের এসব অযৌক্তিক দাবি মানতে নিষেধ করে। বেসরকারি চাকরিজীবী নিরার যুক্তি, আমার বেতনের পুরোটাই ওর হাতে তুলে দিই। তবে তার বাবা-মাকে এবং তাকে আবার খুশি করতে হবে কেন। এরপর প্রকাশ পায় জামাইয়ের প্রকৃত চেহারা। শুরু হয় নিরার গায়ে হাত তোলা। ‘আগে মাঝেমধ্যে নির্যাতনের শিকার হলেও নিরা অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। কিছুদিন ধরে বাবার বাড়ি থেকে নিরাকে ১০ লাখ টাকা আনার জন্য চাপ দেয় স্বামী। কিন্তু নিরা অপারগতা জানালে শুরু হয় ঝগড়া। একপর্যায়ে ওকে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি-লাথি মারে জামাই। এরপর অজ্ঞান হয়ে যায় নিরা।’

বিভিন্ন হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসকেরা জানান, তাঁদের কাছে আসা রোগীদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পারিবারিক নির্যাতনের শিকার। গর্ভকালীন নির্যাতনের শিকার রোগীর সংখ্যাও কম নয়। তাঁরা বলেন, গর্ভকালীন নির্যাতনের ধরনের ওপর নির্ভর করে এতে কতটুকু শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে অথবা এর প্রভাব সাময়িক নাকি স্থায়ী। যেমন চড়-থাপড় হলে শারীরিক ক্ষতি খুব একটা নেই। তবে এ থেকে মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, যা গর্ভের সন্তানের জন্য নেতিবাচক। আবার শারীরিক নির্যাতনের শিকার নারী গুরুতর আঘাত পেলে বিভিন্ন যৌন রোগ, মাথা, ঘাড় ও মেরুদণ্ডে ব্যথা, গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু, গর্ভধারণে জটিলতার মতো সমস্যায় ভুগতে পারেন। এমনকি ওই নারীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক নূরুননাহার প্রথম আলোকে বলেন, গর্ভধারণের প্রথম দিকে পেটে লাথি দেওয়া হলে বা গুরুতর আঘাত পেলে গর্ভপাত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। আবার শেষের দিকে হলে প্রসবের ব্যথা ওঠে, জরায়ুর মুখ খুলে যায়। এতে মা ও বাচ্চা উভয়ের মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। এ ছাড়া গর্ভপাতের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মা মারা যেতে পারেন।

পোশাকশ্রমিক লামিয়া (ছদ্মনাম) প্রথম গর্ভধারণ করে ১৫ বছর বয়সে। তিন মাসের মাথায় গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। এর কারণ হিসেবে চিকিৎসক জানান, অসংযত যৌনমিলন। চিকিৎসক তাকে ১৮ বছরের আগে সন্তান নিতে নিষেধ করেন এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে আবারও গর্ভবতী হয় লামিয়া এবং হরমোনের সমস্যার কারণে পাঁচ মাসের সময় গর্ভপাত হয়। এ বিষয়ে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক ইসমত আরা বলেন, গর্ভধারণের প্রথম তিন মাস যৌনমিলন হলে গর্ভপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়। শেষের তিন মাসও স্বামী-স্ত্রীর যৌনমিলন থেকে বিরত থাকা উচিত। আবার অনেক সময় গর্ভবতী মাকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন ভারী ও অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করে। এতেও গর্ভপাতের আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া গর্ভকালীন মাকে প্রয়োজনীয় খাবার ও চিকিৎসা দেয় না, যা চিকিৎসকদের মতে শারীরিক নির্যাতনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এতে মা ও শিশু উভয়েই অপুষ্টির শিকার হয় এবং নানা শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া চিকিৎসকের কাছে এমন রোগীও আসেন, যাঁরা বাড়িতে গর্ভের সন্তান নষ্ট করার চেষ্টা করেন। এতেও মায়ের ক্ষতি হয়।