নেপালে প্যারাগ্লাইডিংয়ের আনন্দ

পাখির মতো ওড়া
ছবি: সংগৃহীত

দুই মাস আগেই সব ঠিকঠাক। ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু যাওয়ার ফ্লাইট বুকিং, হোটেল বুকিং করাও হলো। টাকাপয়সাও পরিশোধ করা হলো। একসঙ্গে ২৯ জন যাচ্ছি আমরা। ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ-ভ্রমণকন্যার উড়োজাহাজে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। আমি গাইড। তাই উত্তেজনা অন্য রকম। কিন্তু বিপত্তি ঘটল ১৩ ফেব্রুয়ারি।

রিপোর্টে আমার কোভিড পজিটিভ এল। ভয় জেঁকে বসল। যেতে পারব কি না, এই চিন্তা অসুস্থতা যেন আরও বাড়িয়ে দিল। জ্বর-কাশি, শরীরব্যথায় মারাত্মক আকার ধারণ করল। খামোখা সবার চিন্তা বাড়িয়ে লাভ কি! এই ভেবে ট্যুরমেটদের বিষয়টা ইচ্ছা করেই জানাইনি।

যাহোক, নেপালে যাওয়ার দুই দিন আগে আবার করোনার নমুনা পরীক্ষা করালাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ন, রিপোর্ট নেগেটিভ এল। কোভিডের সংক্রমণে ইতিমধ্যে ১৪ জন বাদ পড়েছেন। দলের সংখ্যা তখন ১৫। উড়াল দেওয়ার এক দিন আগে কোভিড টেস্ট করে পজিটিভ এল আরও দুজনের। বাদ পড়লেন তাঁরাও। মানুষগুলোর জন্য ভীষণ মন খারাপ হলো। মেসেঞ্জার গ্রুপে ক্রমাগত কথা হচ্ছিল তাঁদের সঙ্গে। মনে হচ্ছিল, মন খারাপ করে মনসভ্রমণে আমাদের সঙ্গেই আছেন তাঁরা।

অবশেষে নেপালের উদ্দেশে রওনা করলাম। প্রথম দিন কাঠমান্ডু কাটিয়ে দ্বিতীয় দিন পোখারা পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। সবাই খুব ক্লান্ত। রাতেই সবার থেকে জেনে নিলাম কয়জন প্যারাগ্লাইডিং করতে চান। কারণ, স্থানীয় একজন গাইড আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াবেন। সে পরিকল্পনায় প্যারাগ্লাইডিং ছিল না। কিন্তু আমার ইচ্ছা প্যারাগ্লাইডিং করব। একটা টেক্সট করে জানতে চাইলাম, কয়জন করবে? ১১ জন রাজি! গাইডের সঙ্গে কথা বলে পরিকল্পনা বদলাতে হলো।

সকাল সাতটায় সবাই নাশতা করে তৈরি। সাড়ে আটটায় রওনা হওয়ার কথা। কিন্তু আবহাওয়া বিট্রে করায় বেরোতে দেরি হচ্ছিল। আমাদের দলেও আবহাওয়ার প্রভাব পড়েছে। ভ্রমণসঙ্গীদের মধ্যে যে ১১ জন রাজি হয়েছিলেন প্যারাগ্লাইডিং করবেন, ফিও জমা দিয়েছিলেন আগেভাগে, তাঁদের মধ্যে ৩ জন দোনামোনা করতে লাগলেন। দুজনকে প্রায় জোর করে রাজি করালাম। আরেকজনকে বললাম, এটা কোনো ব্যাপার না, জীবনে এমন সুযোগ না–ও পেতে পারেন। একসময় তিনিও রাজি হয়ে গেলেন।

প্যারাগ্লাইডিং এজেন্সি থেকে গাড়িসহ লোক এল। ১০টা বাজে তখন। ছুটলাম গন্তব্যে। প্রথমে প্যারাগ্লাইডিং এজেন্সির অফিসে গিয়ে ফরম পূরণ করতে হলো। তারপর গেলাম সারাংকোট। এখানকার পাহাড়চূড়া থেকে উড়ব আমরা। প্যারাগ্লাইডিংয়ের তিনটি অপশন আছে। আমার ক্রস কান্ট্রি করার ইচ্ছা থাকলেও সময় বেশি লাগবে বলে অ্যাক্রোবেটিং করব বলে পাইলটকে জানালাম। একে একে যে যার পাইলটের সঙ্গে আকাশে উড়ে যাচ্ছে। একসময় আমার ডাক পড়ল। ফ্লাই করার আগে পাইলট সব নিয়মকানুন বুঝিয়ে দিলেন। একসময় আমিও উড়াল দিলাম। উড়ে বেড়াচ্ছি পাখির মতো। পাইলট আমাকে বলেন ছেড়ে দিতে। আমি মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছি। এ আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার নয়।

আমরা যে স্তরে উড়ছিলাম। তার থেকে ওপরে কয়েকজন উড়ছিল। তাদের দেখিয়ে পাইলটকে বললাম, আমি তো অনেক নিচে, আরও ওপরে যাও! পাইলট বিজু ওপরে উঠতে থাকলেন। যেন আকাশ ছোঁব আমরা।

তখন আমি ভয়ডরহীন। শুধুই মুগ্ধ হয়ে চারপাশ দেখছি। নিচে পাহাড়ে শর্ষের খেত, আরেক পাশে হ্রদ। কিছু চিল আমাদের সঙ্গে উড়ছে। মনে হচ্ছিল আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে ওরা।

পাইলটের কাছে জানতে চাইলাম, পকেট থেকে ফোন বের করতে পারব কি না। তিনি বললেন, ‘আপকা রিস্ক হে কার সাকতেহো।’ নেপালিরা হিন্দি ভালোই পারে। সাহস নিয়ে ফোন বের করে প্রিয়জনের জন্য একটা ছোট ভিডিও করলাম। পাইলটদের কাছে গোপ্রো থাকে। তাঁরাই ভিডিও করে ছবি তুলে দেন। তবু নিজের কাছে রাখলাম।

৮-১০ মিনিট উড়ে বেড়ালাম। বিজু আমাকে বললেন, একটু শক্ত করে ধরে রাখতে। শুরু হলো ৩৬০ ডিগ্রি ঘোরা। প্রথম ১ কি ২ মিনিট ভালো লাগলেও ওপর থেকে নিচে নামানোর সময় ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠল। আর বাতাসে চোখে পানি এসে সব ঘোলাটে লাগছিল।

সব মিলিয়ে ১৫-২০ মিনিট উড়ে বেড়িয়েছি। তারপর ল্যান্ড করলাম এক লেকের পাড়ে। মনে হচ্ছিল, জীবনের অন্যতম অনুভূতি নিয়ে নেমে এলাম।