পরিবেশ রক্ষার তির

বিপন্ন পাখিদের উদ্ধার করেন তিরের সদস্যরা
ছবি: সংগৃহীত

২০১৯ সালের ১৬ এপ্রিল। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় উদ্ধার হয় একটি বিরল প্রজাতির লজ্জাবতী বানর। সেখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিপন্নপ্রায় প্রজাতির এ লজ্জাবতীকে হেফাজতে নেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই খবর পৌঁছে যায় বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের তিন শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান, আরাফাত রহমান এবং রিফাত হাসানের কাছে। পরদিন দুপুরের পর তাঁরা পৌঁছান দেওয়ানগঞ্জ ইউএনওর কার্যালয়ে। ততক্ষণে লজ্জাবতী বানর নিতে রংপুর চিড়িয়াখানার লোকজনও পৌঁছেছেন। কিন্তু উপজেলা প্রশাসন লজ্জাবতী বানরটি হস্তান্তর করে তিন শিক্ষার্থীর কাছে।

দেওয়ানগঞ্জ ছাড়তে না ছাড়তেই ময়মনসিংহে আরেকটি লজ্জাবতী উদ্ধারের খবর আসে। ময়মনসিংহ পৌঁছে সেখানে আরেকটি লজ্জাবতীও পেয়ে যান তাঁরা। দুটি লজ্জাবতী বানর নিয়ে পরদিন বাসে রওনা দেন হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের উদ্দেশে। বানর দুটি বন বিভাগের সহায়তায় সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে অবমুক্ত করে চার দিনে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পথের ক্লান্তি নিয়ে বগুড়ায় ফেরেন তিনজন।

মিজানুর রহমান সরকারি আজিজুল হক কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ এবং আরাফাত ও রিফাত প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী। এই তিনজনই শুধু নন, বিপৎসংকুল প্রাণী, প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করছেন সরকারি আজিজুল হক কলেজের একদল শিক্ষার্থী। তাঁরা কাজ করছেন ক্যাম্পাসভিত্তিক সংগঠন ‘তির’ (টিম ফর এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ)–এর জন্য। সেটিও প্রায় এক দশক ধরে। তিরের স্লোগান ‘শেখো করো শেখাও—পরিবেশ বাঁচাও’। তিরের সদস্যরা বন বিভাগ, বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) সঙ্গে কাজ করছেন। গত এক মাসে তিরের সদস্যরা ৭টি হিমালয়ি গৃধিনী শকুন উদ্ধার ও অবমুক্ত করেছেন। আর দশ বছরে ১ হাজার ২৭৪টি বিপৎসংকুল ও অসুস্থ প্রাণী উদ্ধার ও অবমুক্ত করেছেন তিরের সদস্যরা।

২০১১ সাল। শীতের পড়ন্ত বিকেলে সরকারি আজিজুল হক কলেজ ক্যাম্পাসের গাছে গাছে হরেক পাখির ঝাঁক। শিকারির তাড়া খেয়ে উড়ছে পাখি। ফিন্যান্স অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের দুই শিক্ষার্থী সোহানুর রহমান ও নাজমুল হকের মাথায় তখন পাখি রক্ষা, পরিবেশ আন্দোলনে ক্যাম্পাসভিত্তিক একটি সংগঠন গড়ে তোলার ভাবনা আসে।

কদিন পর তাঁরা যান পরিবেশ অধিদপ্তরে। অধিদপ্তরের পরিচালক আবার তাঁদের নিজেদের কলেজেই পাঠান। সরকারি আজিজুল হক কলেজের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের তখকার প্রভাষক এ বি এম আবু হায়দারের সহযোগিতায় প্রস্তুতি সভা ডাকা হলো। সোহান ও নাজমুলের সঙ্গে ভূগোল বিভাগের আরও পাঁচ শিক্ষার্থী গোলাম রব্বানী, জেসমিন, মারুফ হোসেন, রেজওয়ান ও আবদুর রউফ যোগ দেন। সোহানুর রহমানকে আহ্বায়ক এবং নাজমুলকে সদস্যসচিব করে একটি কমিটিও হলো। ওই বছরের ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীর শোভাযাত্রার মাধ্যমে তিরের যাত্রা শুরু হলো।

তিরের সাবেক সভাপতি সোহানুর রহমান বলেন, ‘শুরুতে ক্যাম্পাসে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বন্ধে সচেতনতা নিয়ে কাজ শুরু করি। পরে করতোয়া নদী রক্ষা আন্দোলন ছাড়াও প্রাণী ও পাখি উদ্ধার, চিকিৎসা ও পরিচর্যা, পাখির নিরাপদ আবাস–কলোনি গড়ে তোলা, পাখি শিকার, বন্য প্রাণী হত্যা, নির্যাতন, উত্ত্যক্ত বন্ধে নানা উদ্যোগে যুক্ত হন তিরের সদস্যরা।’ এখন তিরের সদস্য প্রায় ৫০০ জন।

সরকারি আজিজুল হক কলেজ ছাড়াও গত বছর থেকে গাইবান্ধা সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসে তিরের শাখা খোলা হয়েছে। তিরের কোনো কার্যালয় নেই। ক্যাম্পাসে খোলা মাঠে ঘাসে বসেই নিয়মিত বৈঠক করে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হয়। সদস্যরা নিজেরা চাঁদা তুলে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছেন।

তিরের দুই মেয়াদের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ‘কয়েক বছর আগে যমুনা নদীতে ভেসে আসে ১২ কেজি ওজনের একটি বিরল প্রজাতির অজগর। স্থানীয় লোকজনের হাতে ধরা পড়ার খবর পেয়ে সেই অজগরটি উদ্ধার করি। পরে ১২ কেজির সেই অজগর ঢাকা চিড়িয়াখানায় দেওয়া হয়।’

তিরের সদস্যরা পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন অধিদপ্তরের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন। জানালেন তিরের সভাপতি আরাফাত রহমান। তিনি জানান উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে বিপন্ন ও বিরল প্রজাতির শকুন, লজ্জাবতী বানর, গন্ধগোকুল, মেছো বাঘ, বনবিড়াল, শিয়াল, সাপ, অজগরসহ নানা প্রাণী উদ্ধার ও অবমুক্ত করেছেন তাঁরা। বিহার পাখি কলোনি, পালশা গ্রিন ফাউন্ডেশন, ইচ্ছে শক্তি বিদ্যালয় ইত্যাদি পরিচালনা করছে তির।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে সম্মাননা পেয়েছে তির। বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ থেকে শ্রেষ্ঠ সংগঠন হিসেবে পুরস্কার পেয়েছে। পাখি কলোনি সংরক্ষণে সম্মাননা, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশনের (বিবিসিএফ) শ্রেষ্ঠ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পুরস্কার পেয়েছে।

১২ জানুয়ারি বগুড়ার কাহালু উপজেলায় মেটে-মাথা কুড়া ইগল বা গ্রে–হেডেড ফিশ ইগল মাছ শিকারের জন্য বসেছিল গাছের ডালে। কিন্তু একজন পাখিশিকারির বন্দুকের (এয়ারগান) গুলিতে আহত হয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। খবর পেয়ে তিরের সদস্যরা পাখিটি হেফাজতে নিয়ে পরিচর্যার পর ছেড়ে দেন। এভাবেই বিপদাপন্ন প্রাণীদের বন্ধু হয়ে ওঠেন তিরের সদস্যরা।