পাটকাঠির পুড়ে যাওয়া সাদা ছাই

বাবাকে শেষ দেখি ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট। তখন আমার বয়স ৩। বহির্বাড়ির আঙিনায় কামিনী ফুল গাছের তলায় তাঁর মৃতদেহ শোয়ানো। এক দিন আগে গৌরীপুর পোস্ট অফিসের সামনে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে সেখানেই তিনি গুলিতে নিহত হন। ছেলে হিসেবে আমার হাতে একমুঠো জ্বলন্ত পাটকাঠি দিয়ে তাঁকে প্রদক্ষিণ করে হিন্দুরীতি অনুযায়ী মুখাগ্নি করা হয়েছিল। ছোট বলে সম্ভবত আমাকে একজন ধরে রেখেছিলেন। পাটকাঠির পুড়ে যাওয়া সাদা ছাই মৃতের মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়েছিল। সে দৃশ্যটি এখনো মনে আছে। আমার স্মৃতিতে সেটিই বাবার একমাত্র ছবি।

বাবার আর কোনো স্মৃতি আমার মনে নেই। লোকমুখে তাঁর খেলাধুলা আর দুরন্তপনার কথা জেনেছি। আমাকে খুব আদর করতেন বলেও শুনেছি। পাকা আম, জামের রস নাকি ন্যাকড়ায় ছেঁকে আমাকে খাওয়াতেন। আমাদের সময়ে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার সময় অনেকের বাবা স্কুল গেটে গেলেও আমি সেটি পেতাম না। বাবার মৃত্যুতে আমরা ভাই-বোন দুই দেশে ছিটকে গিয়েছিলাম। তবে যৌথ পরিবারে বড় হওয়ার কারণে আমাদের ছোট দুই ভাই বোনের বড় হতে কোনো অসুবিধা হয়নি। পরিবারে নানা প্রতিকূলতায় তাঁর শূন্যতা তেমন একটা অনুভব করিনি। আমার পরিবার সে শূন্যতা পূরণ করেছিল।

একটু বড় হলে এ বোধ থেকে শান্তি পেতাম যে তাঁদের রক্তের বিনিময়েই তো আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। আমি এখন প্রাণ খুলে গাইতে পারি, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’