পাঠকের প্রশ্ন: মন

প্রশ্ন: আমি অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছি। ছোটবেলা থেকেই অনেক পারিবারিক ঝামেলার মধ্যে বড় হই৷ সব সময় কেন জানি একটা হতাশার মধ্যে থাকি। ছোটবেলা থেকেই ক্লাসে পড়া না পারলে বা আমার কোনো বন্ধু যদি আমার থেকে বেশি কিছু পারত, তখন আমার মধ্যে কেমন জানি একটা চাপা হিংসা কাজ করত। এখনো করে। কিন্তু জানি না কেন করে? তখন আমার মনে হয় আমি বোধ হয় জীবনে কিছুই করতে পারব না। এই রকম হতাশা আমাকে সব সময় জড়িয়ে থাকে। কিছুদিন আগে এক ছেলের সঙ্গে আমি প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। কয়েক দিনের পরিচয়ে আমি ওকে অনেক আপন ভাবতে থাকি। ছেলেটা আমাকে দেখে পছন্দ করে কিন্ত আমি তার সঙ্গে কথাবার্তা চলাকালে তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি। এক সপ্তাহের পরিচয়ে আমি তাকে এত পছন্দ করব, যা আমি কখনোই ভাবতে পারিনি। এর কিছুদিন পর সে আমাকে জানায়, তার এই প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে এগুলো ভালো লাগে না, সম্পর্কের ইতি টানতে চায়। আমিও বুঝতে পারতাম ও ঠিক প্রেমিকের মতো না। তারপরও তাকে আমার খুব ভালো লাগত, আমি যে তাকে অনেক পছন্দ করি এই ব্যাপারটা সরাসরি বললাম। কিন্তু ও তার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল। যেহেতু সে আমার সমবয়সী ছিল, ব্যাপারটা আমার ইগোতেও খুব লাগল। আমিও তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিই কিন্তু তারপরও অনেকবার একটু–আধটু কথা হয়েছে। এ ব্যাপারটা আমাকে আরও হতাশ করছে। এই সম্পর্কটা যে এভাবে ভাঙবে, আমি কখনোই ভাবতে পারিনি। সে এভাবে আমার সঙ্গে প্রতারণা করছে, আমি মানতে পারছি না আবার বারবার নিজের মনে প্রতিজ্ঞা করার পরও তাকে ভুলে যেতে পারছি না৷ ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারছি না, সব সময় এগুলো আমার মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে৷ আমার কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন? ধন্যবাদ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
উত্তর: অত্যন্ত সততার সঙ্গে তুমি যে নিজের একটি দুর্বল দিকের কথা অকপটে তুলে ধরেছ, সেটি অনেক বেশি প্রশংসার দাবি রাখে। জানি না শৈশবে থাকা অবস্থায় তোমাকে অন্য কারও সঙ্গে তুলনা করে ছোট করা হতো কি না। পাঁচ থেকে সাত বছর বয়সের মধ্যেই যেহেতু আমাদের ব্যক্তিত্বের গঠনটি হয়ে যায়, সেই সময়ে আমরা চারপাশে থাকা কাছের মানুষের দ্বারা কীভাবে মূল্যায়িত হই, সেটির একটি প্রভাব পরবর্তী সময়ে রয়ে যায়। শিশুদের সত্তাটিকে গ্রহণ না করে আমরা যদি তাদের পারদর্শিতার দিকে বেশি মনোযোগী হই, তাহলে তাদের মধ্যে নিজেকে নিঃশর্তভাবে গ্রহণ করে নেওয়ার মতো মনোভাব তৈরি হয় না। এর ওপরে যদি অন্যদের সঙ্গে ক্রমাগত তুলনা করা হতে থাকে, তাহলে আত্মবিশ্বাস ভীষণভাবে কমে যায়। তোমার যে ব্যক্তিত্বটি গড়ে উঠেছে, সেটির জন্য কিন্তু তুমি সম্পূর্ণ দায়ী নও।
এখন তুমি সচেতন হয়ে তোমার মানসিক উন্নয়নের জন্য চিন্তাধারার পরিবর্তন করে নিজেকে অন্য কারও সঙ্গে তুলনা বন্ধ করে যদি নিজেকে গ্রহণ করে ভালোবাসতে পারো, তাহলে হতাশার পরিমাণ কিছুটা হলেও কমতে পারে। আমরা সবাই একক এবং অনন্য। কারও মতো হওয়ার চেষ্টা না করে বরং নিজেদের ভালো দিকগুলোকে আরও ধারালো করার প্রয়াস আমরা নিতে পারি। শুধু শ্রেণিকক্ষের কৃতিত্বের নিক্তিতে নিজেকে পরিমাপ করা থেকে আমরা বিরত থাকলে খুব ভালো হয়। যেহেতু পারিবারিক ঝামেলার মধ্যে তুমি বড় হয়েছ, হয়তোবা তোমার মনের যত্নটি তেমনভাবে হয়নি। পরিবারের প্রিয় মানুষের সঙ্গে স্নেহ–ভালোবাসাময় নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। সেটির অভাব থাকলে আমরা খুব দ্রুত খুব অল্প পরিচয়ের পরই বাইরের মানুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারি। তাদের প্রতি নির্ভরশীলতা এবং তাদের কাছে প্রত্যাশার পরিমাণও খুব বেশি হয়ে থাকে। যে ছেলেটিকে এখনো তুমি পছন্দ করো, তাকে তো তুমি নিজের আবেগটি সুষ্ঠুভাবে প্রকাশ করেছ। ছেলেটিও কিন্তু খুব পরিষ্কারভাবে তার মনোভাব জানিয়ে দিয়েছে। তুমি যদি নিজের এবং একই সঙ্গে ছেলেটির মনোভাবকে শ্রদ্ধা করতে পারো, তাহলে খুব ভালো হয়। ওর কথা জোর করে ভুলে থাকার চেষ্টা না করে বরং নিজেকে আরেকটু সময় দাও। সে এই মুহূর্তে কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাইছে না। সেটি বলার অর্থ তো অনেক কিছুই হতে পারে তাই না। ওর সঙ্গে তো তোমার সম্পর্ক তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি এবং সে তো কথা দিয়ে সেটি পরে ফিরিয়ে নেয়নি। তুমি যেহেতু এখনো একজন শিক্ষার্থী, নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে আপাতত মনের অনেক যত্ন করো। প্রতিদিন দিনে একবার অন্তত নিজের সত্তাটিকে বলবে, তুমি যেমন ঠিক তেমন করে নিজেকে ভালোবাসবে ও শ্রদ্ধা করবে।
প্রশ্ন: আমার বয়স ১৬ বছর। বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন মানসিক টানাপোড়েন ও অযত্নে ভীষণ স্থূলকায় হয়ে পড়েছি। এ নিয়ে পরিবারের লোকজন ও বন্ধুবান্ধবের ঠাট্টা–রসিকতা শুনতে শুনতে ক্লান্ত। বেশ কয়েকবার ওজন কমানোর জন্য মন স্থির করলেও মাত্র কয়েক দিনেই আগ্রহ একদমই চলে যায় এবং এতে আরও হতাশ হয়ে পড়ি। পড়াশোনায়ও মনোনিবেশ করতে পারছি না। এ রকম হতাশা থেকে মুক্ত হয়ে ওজন কমানো ও পড়াশোনায় কী করে মনোযোগ বাড়াব তা বলে দিলে ভালো হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
উত্তর: তোমার বয়স এখন অনেক কম। এই বয়সে যে তোমার এত বেশি মানসিক টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। সমাজের মানুষগুলো আমাদের প্রতি অনেক সময়ই খুব নিষ্ঠুর আচরণ করে থাকে। কে কোন ধরনের বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যায়, সেটির দিকে খেয়াল না করে নানা রকম কটাক্ষ করতে থাকে। এটি অত্যন্ত অন্যায় আচরণও বটে। এ ছাড়া আমরা যদি মানুষের বাইরের অবয়বটি বাদ দিয়ে ভেতরের সৌন্দর্যের প্রতি বেশি মনোনিবেশ করতে পারতাম, তাহলে সমাজের চেহারাটাও অনেক সুন্দর হতো। তুমি চেষ্টা করো অন্যেরা বলছে বলে নয়, নিজে সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন কিছুটা শরীরচর্চা করতে পারো কি না। যদি নিজের সংকল্পে দৃঢ়তা দেখাতে পারো, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে অনেক বেশি ধন্যবাদ দেবে। স্থূলকায় হওয়ার কারণে শুধু নয়, একটি সুস্থ শরীর ও মনের অধিকারী হওয়ার জন্য আমরা যেকোনো সময়ই নিজের প্রতি যত্নশীল হতে পারি। মনে হচ্ছে তোমার মধ্যে একধরনের বিষণ্নতা তৈরি হয়েছে। সেই কারণেই হয়তো বারবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছ। নিজের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণাগুলো পোষণ করা থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসে তোমার মধ্যে যে মানবিক গুণাবলি রয়েছে, সেগুলোর দিকে বেশি খেয়াল করো। অন্যদেরও তাদের ভালো দিকগুলোর জন্য প্রশংসা করো, যাতে করে তারাও তোমাকে সেটির প্রতিদান দেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেন। লোকে রসিকতা করলেও তুমি সেগুলোকে কিছুটা হলেও অগ্রাহ্য করতে চেষ্টা করো। স্থূলকায় হওয়াটি কিন্তু কোনো অপরাধ নয়। মন ভালো থাকে এমন কিছু কাজে নিজেকে প্রতিদিন ব্যস্ত রাখো। যাতে করে পরবর্তী সময়ে তুমি উৎসাহিত বোধ করে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারো। লেখাপড়া করতে অনেকেরই ভালো লাগে না, তারপরও নিজেকেই প্রতিদিন কিছুটা উৎসাহিত করা সম্ভব হয় কি না দেখো।