পালিয়ে বিয়ে?

ছবিটি প্রতীকী। মা–বাবার অমতে বিয়ে করলেও কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকতে হবে
ছবিটি প্রতীকী। মা–বাবার অমতে বিয়ে করলেও কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকতে হবে

দীর্ঘদিন প্রেমের সম্পর্ক মামুন ও মিতার (ছদ্মনাম)। তাঁদের সম্পর্কের বিষয়টি দুই পরিবারেই জানাজানি হয়ে যায়। মামুনের পরিবার বিয়েতে রাজি হলেও মিতার পরিবার কোনোভাবেই মামুনের সঙ্গে মিতার বিয়ে দেবে না। এদিকে মিতার জন্য তাঁর বাবা-মা পছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক। মিতা ও মামুন দুজনেই সিদ্ধান্ত নিলেন পালিয়ে বিয়ে করবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী দুজনেই গেলেন আইনজীবীর কাছে। সম্পন্ন করলেন বিয়ের হলফনামা। কিন্তু তাঁদের বিয়েটি নিবন্ধন করা হয়ে ওঠেনি। দুজনে জানতেনই না বিয়েটি নিবন্ধন করতে হবে।
আইন কী বলে?
পরিবারের অমতে বিয়ে করতে গিয়ে এখন অপহরণের মামলায় হাজতবাস করছেন শিপন (ছদ্মনাম)। শিপনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, নাবালিকা মেয়েকে অপহরণ করে পাচারের চেষ্টা করেছেন। শিপনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল নিতুর (ছদ্মনাম)। একদিন দুজনে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন। কিন্তু নিতুর বয়স ১৮ বছর না হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা বিয়ের সময় বিষয়টি গোপন করেছিলেন। বিয়ের কথা জানাজানি হওয়ার পর নিতুর বাবা মেয়ে অপহরণের মামলা ঠুকে দেন শিপনের বিরুদ্ধে।

আমাদের সমাজে এমন ঘটনা অহরহ ঘটতে দেখা যাচ্ছে। প্রায়ই দেখা যায়, প্রেমিক যুগল মা-বাবার অমতে পালিয়ে বিয়ে করে। কিন্তু নিজেরা বিয়ে করতে গিয়ে বিয়ের নিয়মকানুন না জানার কারণে অনেক সময় পড়ে বিপদে। অনেককেই বলতে শোনা যায় ‘কোর্ট ম্যারেজ’ করেছে। কিন্তু কোর্ট ম্যারেজ সম্পর্কে না জানার কারণে পরবর্তী সময়ে অনেক ঝামেলাও পোহাতে হয়। আইনে কোর্ট ম্যারেজ বলে কোনো বিধান নেই। এটি একটি লোকমুখে প্রচলিত শব্দ।
কোর্ট ম্যারেজ বলতে সাধারণত হলফনামার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিয়ের ঘোষণা দেওয়াকেই বোঝানো হয়ে থাকে। এ হলফনামাটি ২০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখে নোটারি পাবলিক কিংবা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। এটি বিয়ের ঘোষণা মাত্র। যে ধর্মেই হোক না কেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক আইন অনুযায়ী প্রথমে বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে। তারপর তাঁরা ইচ্ছা করলে এ হলফনামা করে রাখতে পারেন। মুসলিম আইনে বিয়ে নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। হিন্দু আইনে বিয়ে নিবন্ধন ঐচ্ছিক করা হয়েছে। ছেলেমেয়ে মুসলমান হলে কাবিননামা সম্পন্ন করে না থাকলে স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে দাবি করতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

পালিয়ে বিয়ে করলেই কি অপহরণ মামলা?
বিয়ের প্রথম শর্ত হচ্ছে ছেলেমেয়েকে প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। ছেলের বয়স ২১ ও মেয়ের বয়স ১৮-এর ১ দিনের কম হলেও বয়স গোপন করে বিয়ে করলে মামলা-মোকদ্দমায় পড়ার আশঙ্কা থাকবে। বিশেষ করে মেয়ের বয়স ১৮-এর কম হলে মেয়ের অভিভাবক অপহরণের মামলা ঠুকে দিলে ছেলেটির বড় ধরনের জেল-জরিমানার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার মেয়েটি আদালতে গিয়ে স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছে মর্মে জবানবন্দি দিলেও প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত নিরাপদ হেফাজতেও থাকা লাগতে পারে। তাই নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করতে গেলে আইনকানুনও মানতে হবে। তবে মেয়ে যদি প্রাপ্তবয়স্ক হন, তাহলে অপহরণের মামলা করেও কোনো লাভ হয় না। বরং মিথ্যা মামলা করার অভিযোগে মামলা দায়েরকারীকেই উল্টো সাজা পেতে হয়।

যা মনে রাখতে হবে
ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন কে না দেখে। তাই বলে স্বপ্নে একেবারে অন্ধ হয়ে গেলে হবে না। অনেক সময় ভালোবাসার মানুষটিই হয়ে যেতে পারে প্রতারক। দু-একটি ঘটনায় দেখেছি, বিয়ের নামে ভুয়া বিয়ের দলিল তৈরি করে মেয়েটির সঙ্গে কয়েক দিন স্বামী-স্ত্রীর মতো একান্ত সময় কাটিয়ে ছেলেটি সরে পড়ে। হয়ে পড়ে নিরুদ্দেশ। তখন মেয়েটি পড়ে যায় বিপদে। অনেক সময় মেয়েটি গর্ভবতীও হয়ে পড়ে। ফলাফল, বিয়ে প্রমাণ করতে না পেরে সইতে হয় অপমান-বঞ্চনা। তাই ভালোবাসায় আস্থা থাকবে, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে হতে হবে একটু সচেতন। বিয়ে করলে কাবিননামা বা বিয়ের দলিল দুজনের কাছেই রাখতে হবে। আর শুনতে খারাপ লাগলেও ভালোবাসার মানুষটির হাত ধরে বেরিয়ে আসার আগে একটু ভালো করে খোঁজখবর নিয়েই নেন না। বিয়ে তো আর ছেলেখেলা নয়।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট