পুরান ঢাকার তিন বাজার

‘দুর্গাপূজার আগে আগে এদিকে এসেছেন, জমিদারবাড়িতে প্রতিমা গড়া হচ্ছে, সেগুলো আগে দেখে নেবেন নাকি?’

সদরঘাট এলাকায় বাহাদুরশাহ পার্কের ফুটপাতের চা-দোকানে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন পুরান ঢাকার ছেলে সহকর্মী জয়দেব সরকার। এ এলাকায় এসেছি, কাঁসার তৈজসপত্রের খোঁজে, তার আগে যাওয়া যাক জমিদারবাড়িতে। ১৬ সেপ্টেম্বর এভাবেই শুরু হলো বাংলাবাজার, তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার—পুরান ঢাকার এই তিন বাজারে ঘোরাফেরা।

কে এল জুবিলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে জমিদারবাড়ির ঠিকানা—৪৫ নর্থব্রুক হল রোড। এখানে শ্রীশ্রী কালীমন্দির প্রাঙ্গণে চলছে প্রতিমা তৈরির কাজ। প্রতিমাশিল্পী বলাই পাল ও পাঁচ কারিগর এখানে বানাচ্ছেন দুর্গাপূজার প্রতিমা। অনেকগুলো। কোনোটার কাজ প্রায় শেষ, কোনোটার মাটিতে এখনো রং লাগেনি। জানা গেল, এই মূর্তিগুলো ঢাকা শহরের বিভিন্ন পূজামণ্ডপের জন্য তৈরি করা হচ্ছে।

কাঁসার খোঁজে বাংলাবাবাজারে
বাংলাবাজারের কথা শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে বইপত্র, কম্পিউটার কম্পোজ, বই ছাপা, বাঁধাই ইত্যাদির ছবি। তাই যখন কাঁসার দোকান দেখতে বাংলাবাজারে যাওয়ার কথা শুনলাম, খটকাই লেগেছিল। এখানেই নাকি খাঁটি কাঁসার ঐতিহ্যবাহী দুটি দোকান রয়েছে।
ভরদুপুরে পৌঁছালাম ৪৫ বাংলাবাজার ঠিকানার কম্পিউটার মার্কেটের সামনে। এখানে নিচতলায় শ্রীশ্রী ঢাকেশ্বরী বাসনালয়। এর দুটি দোকান পরেই নিউ রাসমোহন বাসনালয়।
শ্রীশ্রী ঢাকেশ্বরী বাসনালয়ে বসতে না বসতেই একজন ক্রেতাকে ঢুকতে দেখা গেল। এসেছেন বরিশালের গৌরনদী থেকে।
‘কাঁসি আছে?’ দোকানি তাঁকে দেখাচ্ছেন। কয়েকটা কাঁসি বাজিয়েও শোনালেন। ক্রেতার মনে হলো পছন্দই হয়েছে। ‘বললেন, আগেরটা ফুটো হয়ে গেছে, বাড়ির পূজার জন্য নতুন কাঁসি লাগবে।’ এরপর তিনি তাঁর ব্যাগ থেকে বের করলেন পুরোনো কাঁসি। দু-এক জায়গায় ফুটো এবং কাঁসা পাতলা হয়ে গিয়ে এর আওয়াজ ফেটে যায়। দোকানি দেখলাম পুরান কাঁসি ওজন করছেন, মানে কাঁসার পুরোনো জিনিসও এখানে বেচা যায়।
এই দোকানের বিক্রয়কর্মী রাজু জানালেন, এখানে কাঁসা, পিতল ও তামার সব রকম সামগ্রীই পাওয়া যায়। ঘণ্টা, কাঁসি, প্রদীপ, পঞ্চপ্রদীপ পূজার সব অনুষঙ্গ এ সময়টা বেশি বিক্রি হয়। সারা বছর কাঁসা-পিতলের থালা-বাটি-গ্লাসের চাহিদা কমবেশি থাকেই। আবার কিছু শোপিস আছে তামা আর পিতলের।

‘তবে কাঁসা-পিতলের সুদিন তো আর নেই, কিছু কিছু চাহিদা আছে।’ বললেন ঢাকেশ্বরী বাসনালয়ের স্বত্বাধিকারী সুবল চন্দ্র দেব। জানালেন বংশপরম্পরায় চলা এই দোকানের বয়স আড়াই শ বছর।
কাঁসা, পিতল, তামার তৈজস বিক্রি হয় কেজি দরে। কাঁসার দাম ১ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। পিতল ৫০০ থেকে ১ হাজার ২০০ আর তামার তৈজসপত্র পাওয়া যায় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা কেজি দরে।

বাংলাবাজার থেকে বেরিয়ে আমরা যাব শাঁখারীবাজার ভায়া তাঁতীবাজার। কয়েক কদম এগোতেই চোখে পড়ল শুভেচ্ছা কার্ডের কয়েকটি দোকান। একটা ব্যানার দেখে ঢুকে যাই প্রজাপতি কার্ড সেন্টারে। এখানে বিয়ে, জন্মদিন ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের কার্ড ছাড়াও পূজার কার্ড পাওয়া যায়। স্বত্বাধিকারী দিলীপ কুমার আচার্য্য বললেন, সাধারণত বিভিন্ন পূজা কমিটি এই কার্ডগুলো কিনে ছাপিয়ে নেন। দুর্গাপূজার আমন্ত্রণ জানাতেই কার্ডগুলো ব্যবহৃত হয়। পূজায় ব্যক্তিগত শুভেচ্ছা জানানোর কাজে এসব কার্ড তেমন একটা চলে না।

খাঁটি নিরামিষের খোঁজে
পাটুয়াটুলী হয়ে আমরা এগোতে থাকি। পূজার কেনাকাটা আর দৈনন্দিন বাণিজ্যের কারণে রাস্তায় রিকশা, গাড়ি, ঠেলাগাড়ির ভিড় ঠেলে হাঁটাও দুষ্কর। তাঁতীবাজার হয়ে আমরা যাব শাঁখারীবাজারে। সেখানেও কাঁসার দোকান রয়েছে। তাঁতীবাজারে ঢোকার মূল কারণ নিরামিষ পদের হিন্দু হোটেল খোঁজা।
নভ রায় লেনে ইশকন পরিচালিত সবজিঘরে যাই আমরা। চকচকে ইস্পাতের থালাবাটি, গ্লাসে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন অনেকেই। আমাদের উদ্দেশ্য জানাতেই দোকানের স্বত্বাধিকারী জগৎপতি নিত্যানন্দ বললেন, ‘আজ কথা বলে যান, ছবি কাল এসে তুলবেন। আজ একাদশী, তাই পদ বেশি নেই।’ দেখা গেল খাবারের মেনুতে সেদিন রয়েছে পায়েস, বাদাম ভুনা, আলুর চিপস, সাবুদানার ডাল ও সবজি। তবে অন্য দিনগুলোতে ফুলকপির রসা, ছানার রসা, বাঁধাকপির রসা, সয়াবিনের ডাল, পুঁইশাক, করলা, কাঁকরোল ভাজি, চাটনি, পনির ধোকা পাওয়া যায়। এই হিন্দু হোটেলের খাঁটি নিরামিষ পদের স্বাদই আলাদা। জগৎপতি বললেন, ‘এই হোটেলে রসুন-পেঁয়াজ ঢোকে না।’ নিয়মের জন্যই আদা, মরিচ আর অন্যান্য মসলা দিয়েই চলে রান্নাবান্না।

এবার আরেকটি নিরামিষ হোটেলের পথে পা বাড়াই তাঁতীবাজারেই। জগন্নাথ ভোজনালয়। চাপা সিঁড়ি দিয়ে উঠে ১১০ তাঁতীবাজার ঠিকানার দোতলায় এই হোটেল। বেশ পরিচ্ছন্ন। একাদশীর কারণে এখানেও সেদিন পদের সংখ্যা কম। তবে ঢ্যালা খিঁচুড়ি আর পোলাও দেখা গেল। অন্যান্য দিন অন্ন (সাদা ভাত), ছানার রসা, সয়াবিনের রসা, ফুলকপির রসা, বড়ার রসা, কাঁচকলার রসা, সুক্তো মটর ডাল, সজিনার তরকারি, কলার মোচার তরকারি, কাশ্মীরি ছানা, বুট/মাষকলাই/মুগ ডাল, পাঁচ তরকারি, লাউ, পায়েস, দই ইত্যাদি পদ রান্না সকাল-দুপুর-রাত মিলিয়ে। ভাতের দাম ৫ টাকা, অন্যান্য পদের দাম ১৫ থেকে ২৫ টাকার মধ্যেই। এই হোটেলের রসুইঘরেও পেঁয়াজ-রসুনের প্রবেশাধিকার নেই।

শাঁখারীবাজারে কাঁসার তৈজস
তাঁতীবাজার দিয়ে আমরা ঢুকি শাঁখারীবাজারের সড়কে। পরদিন (১৭ সেপ্টেম্বর) ছিল বিশ্বকর্মা পূজা। তাই দোকানপাটের বেশির ভাগেই চলছিল ধোঁয়ামোছার কাজ। এই রাস্তায় যেন বাড়িতে বাড়িতে মন্দির। দুর্গাপূজার সময় দেখা যাবে মণ্ডপের পর মণ্ডপ। শাঁখা, পলা, শাড়ি, গয়নার সব দোকান সারি সারি। আমরা ঢুকে যাই নাগভান্ডারে। এখানে কাঁসা, পিতল, তামার নানা জিনিস রয়েছে। স্টিলের তৈজসও রয়েছে। দোকানের স্বত্বাধিকারী প্রদীপ নাগ বললেন, কাঁসার জিনিসপত্র সব আসে মানিকগঞ্জের ধামরাই, জামালপুরের ইসলামপুর আর চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। শাখারীবাজারে ঢোকার মুখেই আছে আরেকটি কাঁসার দোকান। নাম ধামরাই বাসনালয়। এখানেও একই ধরনের তৈজসপত্র, দামও একই রকম।
পূজার প্রস্তুতি নানাভাবেই দেখা গেল এই তিন বাজারে। গরমটাও বেশ ছিল সেদিন। ফেরার পথে তাই জনসন রোডের বিউটি শরবত ও লাচ্ছির দোকানে প্রাণ জুড়িয়ে নেওয়া।