পুয়েট, হতাশার মোড়, বিচ্ছেদ পয়েন্ট এবং অন্যান্য...

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে হয়ে যায় ক্যাম্পাসের নানা জায়গার নামকরণ। এসব নামকরণের পেছনের গল্প লিখেছেন ফুয়াদ পাবলো

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সবচেয়ে সুন্দর জায়গুলোর একটি হলো সুইজারল্যান্ড
ছবি: সাখাওয়াত হোসেন

দেশে বসেই সুইজারল্যান্ড দর্শন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সবচেয়ে সুন্দর জায়গুলোর একটি হলো সুইজারল্যান্ড। ছোট ও মাঝারি আকারের টিলা, দৃষ্টিনন্দন হ্রদের পানিতে পদ্ম, বাহারি গাছ আর ফুল এবং বড় বড় গাছগাছালিতে ভরপুর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই জায়গা ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের কাছে সুইজারল্যান্ড নামে পরিচিত।

নামকরণের পেছনের কারণটা সহজ—সৌন্দর্য। যেন বাংলাদেশে বসেই এক টুকরা সুইজারল্যান্ড দর্শনের সুযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাওলানা ভাসানী হলের ঠিক বিপরীতে এর অবস্থান। সুইজারল্যান্ডে প্রবেশমুখের দিগন্তজোড়া কাশফুলের মাঠ আর পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্য মনকে উদাস করে দেয়।

বুয়েটের পুয়েট!

১৯০৮ সালে আহছানউল্লা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল নামে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। ১৯৬২ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর নাম দেওয়া হয় পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় বা সংক্ষেপে ইপুয়েট। যদিও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তিত হয়েছে, তবু সেই ইপুয়েটের কাছাকাছি একটি নাম কিন্তু এখনো বিদ্যমান! বুয়েট ক্যাম্পাসের ইসিই বিল্ডিংয়ের অবস্থান পলাশীর পশ্চিম প্রান্তে। পলাশীতে অবস্থিত হওয়ার কারণে এই জায়গাটি বুয়েটের শিক্ষার্থীদের কাছে ‘পুয়েট ক্যাম্পাস’ নামে পরিচিত। ঢাকেশ্বরী মন্দির রোড হয়ে পলাশীর মোড় যাওয়ার পথেই আপনার চোখে ধরা দেবে পুয়েট—যেখানে রাস্তার পাশে বড় করে লেখা আছে পশ্চিম পলাশী ক্যাম্পাস বুয়েট।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিকেত প্রান্তর

গান থেকে উঠে আসা অনিকেত প্রান্তর

অনিকেত প্রান্তর হলো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) বিস্তর এক প্রান্তর। অনিকেত প্রান্তর শাব্দিক অর্থে যেমন, তেমনই এই জায়গাটিও বেশ নির্জন এবং কোলাহলমুক্ত বিরাণ এক জায়গা। এ কারণেই শিক্ষার্থীদের কাছে জায়গাটি পরিচিতি পায় অনিকেত প্রান্তর নামে। ক্যাম্পাস খোলা থাকলে বিকেল নামতেই যে মাঠে জমে উঠতে শুরু করে গল্প, আড্ডা আর গান। আর্টসেল ব্যান্ডের ‘অনিকেত প্রান্তর’ গানটিও হয়তো শুনতে পাবেন কান পাতলে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মূল সড়ক দিয়ে ঢুকে সোজা পথে হাঁটলে পাওয়া যাবে অদম্য বাংলা, তার পাশেই বিখ্যাত তপনদার দোকান। এর পেছনে অনিকেত প্রান্তর।

অনিকেত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা স্তম্ভগুলো মুক্তিযুদ্ধের বড় এক ইতিহাসের সাক্ষী। বর্তমানে ক্যাম্পাসের দ্বিতল শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভবনটিতে চালানো হতো বেতার কার্যক্রম। যুদ্ধকালীন এই রেডিওস্টেশন ছিল একটি নির্যাতন ও গণহত্যাকেন্দ্র। এই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো প্রশাসনিক ভবনটি তখন ছিল একটি একতলা ভবন এবং বর্তমান অনিকেত প্রান্তরজুড়ে ছিল বিশাল এক রেডিও টাওয়ার।

বিচ্ছেদ পয়েন্টের আছে অন্য রকম বিচ্ছেদের গল্প

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) সবচেয়ে অদ্ভুত জায়গার নামের একটি বিচ্ছেদ পয়েন্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি), শেরেবাংলা হল এবং কবি বেগম সুফিয়া কামাল হলের তিনটি পথ এসে যেখানে মিলেছে সেখানেই এই পয়েন্ট। কোনো প্রেমিক যুগলের বিচ্ছেদের কাহিনি থেকেই জায়গার নামটি—এমন যদি আপনি ভেবে থাকেন, ভুল হবে।

কেননা বিচ্ছেদ পয়েন্ট নামটি হয়েছে ভিন্ন কারণে। ক্যাম্পাসে কোনো কাজ শেষে এখানে এসেই মূলত ছেলে ও মেয়েরা নিজ নিজ হলের পথে হাঁটেন। বিচ্ছেদ ঘটে তাঁদের। সে ভাবনা থেকেই এই জায়গাটি শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিতি পায় বিচ্ছেদ পয়েন্ট নামে।

মল চত্বর
ছবি: দীপু মালাকার

মল চত্বরের আছে অন্য তাত্পর্য

ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসের সবচেয়ে জমজমাট এলাকার মধ্যে নিশ্চয়ই মল চত্বর একটি। ক্যাম্পাস খোলা থাকলে শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখর থাকে এই এলাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন ও রেজিস্ট্রার ভবনের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত এই চত্বরটির নামকরণ নিয়ে অনেকের মধ্যেই আছে ভুল ধারণা। কেউ কেউ মনে করেন, এখানে একসময় অনেক ময়লা ফেলা হতো, তাই নাম রাখা হয়েছে মল চত্বর। আবার অনেকের মতে, সকালবেলা কাকের মল ছড়িয়ে থাকে বলে জায়গাটির এমন নামকরণ।

কিন্তু আদতে তা নয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সাবেক ফরাসি সংস্কৃতিমন্ত্রী আঁন্দ্রে মারলোর সম্মানে ঢাবিতে একটি চত্বরের নামকরণ করা হয়। আঁন্দ্রে মারলো ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেককে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেন। চত্বরটি যখন নামকরণ করা হয়, তখন সেটির নাম ছিল মারলো চত্বর। কালক্রমে এটিই বিকৃত হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মল’ নামে। যদিও গুগল ম্যাপসে এখনো জায়গাটি পাওয়া যাবে মার্লো চত্বর নামেই।

হতাশার গল্পে মোড়ানো হতাশার মোড়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের প্রিয় জায়গাগুলোর মধ্যে একটি হতাশার মোড়। মেয়েদের আবাসিক প্রীতিলতা হলের সামনের মোড়টির নামের পেছনের গল্পটাও হতাশামাখা। ক্যাম্পাসে চাউর আছে, এ মোড়টির নামকরণের পেছনে রয়েছে এক ব্যর্থ প্রেমিকের হতাশার প্রতিচ্ছবি। যে কিনা প্রীতিলতা হলেরই এক ছাত্রীকে বারবার প্রেম নিবেদন করেও ব্যর্থ হয়ে হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় কখনো ফুল নিয়ে, কখনো বই নিয়ে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিয়েছে এই মোড়ে। সেখান থেকেই মোড়টির এমন নামকরণ। নামটি হতাশার মোড় হলেও জায়গাটি কিন্তু শিক্ষার্থীদের পদচারণে বেশ প্রাণবন্ত থাকে।

কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) ডায়না চত্বর
ছবি: নাছির উদ্দিন

প্রিন্সেস ডায়ানার স্মরণে

ব্রিটিশ রাজপরিবারের পুত্রবধূ প্রিন্সেস ডায়ানা নানা মানবসেবামূলক কাজে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৯৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর আকস্মিক মৃত্যু তাই বিশ্বের মানুষকে নাড়া দেয়। যার প্রভাব থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশও। প্রিন্সেস ডায়ানা যে বছর মারা যান, সে বছরই তাঁর স্মরণে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) একটি চত্বরের নাম রাখা হয় ডায়না চত্বর।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আড্ডাবাজদের জন্য অন্যতম আদর্শ জায়গা হিসেবে পরিচিত ডায়না চত্বর। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে প্রশাসনিক ভবনের সামনেই চত্বর। এ চত্বরের বিশালতা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সুবিশাল আলবেজিয়াছগাছ ও গয়নার মতো চত্বরটাকে ঘিরে আছে সোনালুগাছ।