শারদীয় দুর্গাপূজার সপ্তমীর বিকেলে (১৩ অক্টোবর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে পা রাখতেই মনে হলো হলটার যেন বিয়ে। ভেতরে আলোকসজ্জা। তখনো ভিড়টা তেমন জমে ওঠেনি। নানা কিছুর পসরা সাজানো চকচকে দোকানগুলোও যেন মলিন। অবশ্য তা মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই একসঙ্গে জ্বলে উঠেছে লাখো টুনিবাতি। হু হু করে ঢুকছে মানুষ। যদিও বিকেলের রূপ অন্য। মণ্ডপের সামনে বিচ্ছিন্নভাবে মানুষ ঘোরাফেরা করছে, ছবি তুলছে। স্পিকারে বেজে চলেছে উৎসবের গান, কীর্তন।
জগন্নাথ হলের মাঠের দিকে এগিয়ে দেখা গেল, অনেকেই একটু স্বস্তিতে, স্বচ্ছন্দে বিকেলটা কাটাতে বেছে নিয়েছেন মাঠটাকে। এক মা আর মেয়ে একে অপরের ছবি তুলে দিচ্ছেন। মায়ের পরনে লাল পাড়ের শাড়ি, মেয়ে পরেছে লাল সালোয়ার–কামিজ। মানুষ দুজন হলেও ফুলের মালা একটিই। সেই একটি ফুলের মালা প্রথমে মেয়ে মাকে পরিয়ে দিল। দিয়ে ছবি তুলে দিল। ছবি দেখিয়ে মেয়ে মাকে বলল, ‘দেখেছ, সবুজ মাঠে লাল মা!’ এবার মা খোঁপা থেকে ফুলের মালাটা খুলে মেয়ের মাথায় পরিয়ে দিলেন। মায়ের তুলে দেওয়া ছবিগুলো যেন ঠিক মনঃপূত হলো না মেয়ের।
ওদিকে আবার কোলাহল থেকে খানিকটা দূরে বসে নিজেদের জন্য নৈঃশব্দ্য তৈরি করে নিয়েছে এক জুটি। মেয়েটির পরনে হলুদ–কমলা শাড়ি, ছেলেটি পরেছে সবুজ পাঞ্জাবি। ছবি তোলার সময় ছেলেটিই দৌড়ে এসে মেয়েটির শাড়ি, চুল, এটা–সেটা ঠিক করে দিচ্ছেন। এদিকে আবার খোলা মাঠ পেয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে শিশুরা। এক পাশে একই প্রিন্টের পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে একদল তরুণ হাসিমুখে স্টেডিয়ামের ওপাশটায় তুলছেন ছবি।
বরাবরের মতো এবারের পূজাতেও বেশির ভাগ নারী বেছে নিয়েছেন লাল পাড়ের শাড়ি। অনেকে আবার এই গরমে শাড়ি রেখে পরেছেন সালোয়ার–কামিজ। তবে শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ যা–ই হোক না কেন, সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে লাল রং। আর ব্লাউজের কাটে এসেছে বৈচিত্র্য।
বেশ কয়েক বছর ধরেই বৈচিত্র্যময় ব্লাউজের কাটের ফ্যাশন বেশ জনপ্রিয়। মহামারিকালের বিধিনিষেধ পেরিয়ে বেরিয়ে উৎসবে শাড়ি পরা নারীদের পরনে এবার বিচিত্র ব্লাউজ মনোযোগ কাড়ছে। এই গরমে অনেকেই তুলে নিয়েছেন হাতাকাটা বাহারি ব্লাউজ। শাড়ির চেয়ে ব্লাউজের নকশাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। শাড়ির রঙের সঙ্গে না মিলিয়ে বরং সম্পূর্ণ বিপরীত রঙের ব্লাউজের চল এসেছে। অনেকেই মাল্টিরঙা ব্লাউজ পরেছেন। পাথর, ব্রোচের ব্লাউজেও আছে লেইস, টারসেল আর ঝুনঝুনি।
অনেকে আবার বর–বউ মিলিয়ে একই প্রিন্টের শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরেছেন। আবার দুজনের কাপড়েই মিলিয়ে হাতে আঁকা একই রকম নকশা, এমনটিও চোখে পড়ে। অনেকে আবার দলবল ধরে একই শাড়ি পরে এসেছেন। দুর্গাপূজার সাজ সব সময় রঙিন। যিনি লাল শাড়ি পরেননি, তাঁর পরনে ও পোশাকেও ছিল নীল, সবুজ, লালের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া গাঢ় গোলাপি, ময়ূরের পেখমের রঙের মতো রঙিন পোশাক।
গরমটা যে অন্যবারের চেয়ে বেশি, সেই রায় দিয়েছেন অনেকেই। তাই বলে মেকআপের সঙ্গে আপস চলেনি। জমকালো শাড়ি, গাঢ় লিপস্টিক, চোখভর্তি কাজল, ভারী মেকআপ—গরম আটকাতে পারেনি কিছুই। কিন্তু মাস্কে ঢাকা পড়েছে অনেকটাই। অনেকের ক্ষেত্রে তাই মাস্কের ঠাঁই হয়েছে থুতনিতে।
মণ্ডপে মণ্ডপে খিচুড়ি, লুচি, লাবড়া তো ছিলই, বাইরে ছিল নাড়ুসহ নানান পদের মিষ্টান্ন। মণ্ডপে মণ্ডপে ছিল ধর্মনির্বিশেষে মানুষের ভিড়। তেমনটাই চোখে পড়ল রাজধানীর বাসাবোর বালুর মাঠ অঞ্চলের দুটো পূজামণ্ডপে। সেখানে সনাতনীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভিড় ছিল মুসলিম নারী–পুরুষ আর শিশুদের। বিকেল ফুরিয়ে আসতে না আসতেই বাজতে শুরু করল ঢাক। আর সেই সঙ্গে নাচ! ঢাকায় যানজট আছে, গরম আছে, করোনার ভয়ও কেটে যায়নি। তবে সেই সবকে ছাড়িয়ে আছে ভিড় ঠেলে হাসিমুখে মানুষের রঙিন উৎসবযাপন!