প্রতিবাদেও কেন থামছে না ধর্ষণ

ধর্ষণের ঘটনায় নাগরিক সমাজ যখন প্রতিবাদমুখর, ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিতে সোচ্চার, সেই সময়টাতেও প্রতিদিন ঘটছে এই যৌন সন্ত্রাসের ঘটনা। এর কারণ কী? আইন, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ—কোনো কিছুই কেন থামাতে পারছে না ধর্ষণের ঘটনা?

গ্রাফিকস: মনিরুল ইসলাম

বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ধর্ষণের ঘটনা পত্রিকার পাতায় স্থান পায়। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর—এই নয় মাসে প্রতিদিন গড়ে তিনটির বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এই সংখ্যা শুধু থানায় মামলা করা ধর্ষণের নজির। এর বাইরেও রয়ে যায় অগণিত ধর্ষণের ঘটনা, যেগুলো থানায় মামলা কিংবা গণমাধ্যমে নানা কারণে আসে না। মাঝেমধ্যে পত্রিকায় মানসিক বিকারগ্রস্ত নারীর সন্তান জন্মদানের খবর প্রকাশিত হয়। তাঁর সঙ্গে কেউ মানবিক আচরণ করলে কখনো কখনো আসে পুরস্কারও। কিন্তু এর পেছনের কারণ সম্পর্কে সমাজ, রাষ্ট্র নীরব থাকে।

একজন মানসিক ভারসাম্যহীন নারী কীভাবে গর্ভবতী হন, সেটির খোঁজ কেউ নেয় না। এই সমাজেরই কেউ না কেউ তাঁকে ধর্ষণ করে, যার কারণে তিনি প্রসব বেদনায় রাস্তায় কাতরাতে থাকেন। এর মানে হলো, আমাদের সমাজে আনাচকানাচে রয়েছে ধর্ষক, যাদের থেকে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন নারীরও মুক্তি নেই। আর ধর্ষক জানে, এই নারী কখনো আদালতে বিচার চাইতে পারবেন না, কিংবা থানায় তিনি মামলা করতে পারবেন না। কারণ তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন। তাহলে আইন দিয়েই কি বন্ধ হবে ধর্ষণ?

দেশে ধর্ষণ নিয়ে প্রতিদিন এত এত প্রতিবেদন, এত প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ডাক, হালের মৃত্যুদণ্ডের অধ্যাদেশ, কিছুই রুখতে পারছে না ধর্ষণের ঘটনা। বরং দেখা যায়, কোনো কোনো ধর্ষণ ব্যাপক আলোচিত হলে এবং সে ঘটনা ঘিরে আন্দোলন জোরদার হলে কিংবা থানায়, পাড়ায়, মহল্লায় এর বিরুদ্ধে মানববন্ধন–বিক্ষোভ তৈরি হলে তার পরদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে ধর্ষণের খবর আসতে থাকে। অর্থাৎ ধর্ষণ বেড়ে যায়। এর কারণ কী? কেন আইন, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ কোনো কিছুই থামাতে পারছে না ধর্ষণ?

ছবি: সাজিদ হোসেন

ধর্ষণ যৌন সন্ত্রাস

পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার চূড়ান্ত সহিংস রূপ হলো ধর্ষণ। ধর্ষণকে এখনো আমাদের সমাজে ‘ইজ্জত, সম্ভ্রমহানি’ কিংবা শ্লীলতাহানি হিসেবে পাঠ করা হয়। একে যৌন সন্ত্রাস বা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় না। অন্য অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীকে সামাজিক হেনস্তার শিকার হতে হলেও ধর্ষণের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী নারীকে হেনস্তা এবং আরও বেশি মানসিক নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হয়। বিপরীতে ধর্ষককে কোনো ধরনের হেনস্তার শিকার হতে হয় না বরং পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা নারীর ‘কাপড়ের দোহাই’–এর মতো আজগুবি এবং অগ্রহণযোগ্য গালগল্প হাজির করে দিয়ে ধর্ষণকে বৈধ করার চেষ্টা করে।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, বাংলাদেশের বেশির ভাগ ধর্ষণ মামলার অভিযুক্তরা গ্রেপ্তারের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জামিনে মুক্তি পান। তবে এই জামিন তাঁদের জন্য অতি দ্রুত হয়, যাঁরা ক্ষমতাবলয়ের কাছাকাছি থাকেন। তারপর তাঁরা কী করেন? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত মুক্তিপ্রাপ্তরা প্রথমেই মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন মামলার বাদী এবং তাঁর পরিবারকে। সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে যান। এই ধর্ষণের মামলাগুলোর বিচারকার্য চলে ১০ বছরের অধিক।

কয়েক বছর আগে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছিল, নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের মামলার শাস্তি হয় মাত্র ৩ ভাগের; বাকি ৯৭ শতাংশ মামলার আসামিরা শাস্তির বাইরেই থেকে যান। এর মধ্যে যাঁরা ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন তাঁরা জানেন, কিছু হবে না। পার পেয়ে যাবেন এবং বাদীপক্ষের ওপর ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানা ধরনের চাপ দেওয়া তাঁদের আরও সহজ হবে। সেই চাপের কারণে অনেক সময় দেখা যায় বাদীপক্ষ মামলা তুলে নেয় কিংবা দীর্ঘদিন মামলা চালাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বাদীর অর্থনৈতিক অবস্থা যদি অসচ্ছল হয় তখন এই দীর্ঘ সময়ে মামলা চালিয়ে যাওয়া তাঁদের জন্য আরও কঠিন হয়ে পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে পারেনও না। তাহলে এখন প্রয়োজন ধর্ষণের মামলা অতি দ্রুত বিচার এবং প্রয়োজনে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করা।

ছবি: রয়টার্স

নজরদারি নেই

ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা জামিনের পর কী করছেন তার খোঁজখবরও কেউ রাখছে না। যদি তিনি ক্ষমতাশালী হন তাহলে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। আর যে কমসংখ্যক ব্যক্তি শাস্তি পাচ্ছেন, তাঁদের শাস্তিও অনেক সময় যাবজ্জীবন হলেও দেখা যাচ্ছে এর আগেই তাঁরা জেল থেকে মুক্তি পেয়ে যান। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বেশির ভাগ সময়ই তাঁদের টার্গেট হয়ে ওঠে সেই মামলার বাদী অর্থাৎ ধর্ষণের শিকার নারী ও তাঁর পরিবার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁরা আরও বেশি ধর্ষণ এবং খুনের মতো অপরাধে জড়িয়ে যান।

রাজনৈতিক মোকাবিলা জরুরি

ধর্ষণকে কোনোভাবেই সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় ব্যাধি হিসেবে দেখলে চলবে না, এটিকে দেখতে হবে রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে, যার পেছনে কাজ করছে লিঙ্গীয় ও যৌন রাজনীতি। তাই এগুলোকে চেপে না রেখে ফিসফাসের জায়গা থেকে বের করে আনা প্রথম জরুরি কাজ। গণমাধ্যমকেও এই বিষয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীলতার মধ্য দিয়ে প্রতিবেদন করতে হবে যাতে ‘রাতভর ধর্ষণ’–এর মতো শব্দগুলো বারবার ব্যবহারের চেয়ে ধর্ষণের শাস্তি বারবার জানাতে হবে।

ধর্ষণ অপরাধের দ্রুত বিচারের পাশাপাশি বিচার চলাকালীন এবং পরবর্তী সময়ে নারী এবং সেই পরিবারের ট্রমা, নিরাপত্তা বিষয়টিও প্রাধান্য দিয়ে সামনে আনা জরুরি। এর পাশাপাশি অভিযুক্ত এবং প্রমাণিত ধর্ষক জেল থেকে জামিন এবং ছাড়া পাওয়ার পর তাঁদের ডেটাবেইস তৈরি করা এবং তাঁদের ওপর নজরদারি রাখাও অতি প্রয়োজন। তার সঙ্গে আরও প্রয়োজন ধর্ষণকেন্দ্রিক সামাজিক বোঝাপড়ার জায়গাটিতে কাজ করা। ধর্ষণ নারীর বিষয় নয়, এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন। এই লড়াইয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পুরুষকে বেশি করে লড়তে হবে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে।