
প্রতিবেশীদের সুযোগ-সুবিধার কথা বাদ দিয়ে আমরা ইচ্ছামতো চলতে পারি না। প্রচলিত আইন আমাদের নিষেধ করে দিয়েছে। আইনিভাবেই প্রতিবেশীদের রয়েছে কিছু অধিকার। তাদের এ অধিকারকে সম্মান দিতে হবে। মনে রাখতে হবে এটা শুধু তাদের অধিকারই নয়, এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে তারা আইনের আশ্রয়ও নিতে পারে। এমনকি আপনিও প্রতিবেশী হিসেবে বঞ্চিত হলে এই আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।
ভবন বানাতে হবে প্রতিবেশীর সুবিধা দিয়ে
ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২ ও ২০০৬ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালার অধীনে দালানকোঠা নির্মাণ করতে হবে। এ আইন অনুযায়ী ভবন নির্মাণ যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, সে উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ভবন ব্যবহার করা যাবে না। অর্থাৎ, আবাসিক বাড়ির জন্য অনুমতি নিলে ওই ভবনকে আবাসিক কাজেই ব্যবহার করতে হবে, অন্য কোনো কাজে যেমন বাণিজ্যিক বা ব্যবসার জন্য ব্যবহার করা যাবে না।
এ নিয়ম না মানলে প্রতিবেশীরা নিতে পারে আইনের আশ্রয়। তারা যদি এমন কোনো ভবনের বিষয়ে অভিযোগ করে তাহলে সরকারের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ওই ভবন ভেঙে ফেলার বা অপসারণের নির্দেশ দিতে পারবে। অবৈধভাবে কোনো প্রতিবেশীর জায়গা দখল করে ভবন নির্মাণ করা যাবে না। এতে প্রতিবেশীরা দেওয়ানি আদালতের আশ্রয় নিতে পারে। মনে রাখতে হবে, ভবন বা ভবনসংলগ্ন রাস্তা বা এর সঙ্গে সংযোগকারী কমপক্ষে ৩ দশমিক ৬৫ মিটার প্রশস্ত রাস্তা থাকতে হবে। তবে ব্যক্তিমালিকানাধীন রাস্তার ক্ষেত্রে কমপক্ষে তিন মিটার প্রশস্ত রাস্তা থাকতে হবে। মালিকানা উল্লেখ না থাকলে রাস্তা সর্বসাধারণের রাস্তা হিসেবেই গণ্য হবে।
দুই রাস্তার সংযোগস্থলের কোণে এক মিটার জায়গা রাস্তা সরলীকরণের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। কাছের কোনো রাস্তার কেন্দ্র থেকে কমপক্ষে সাড়ে চার মিটার অথবা রাস্তাসংলগ্ন সীমানা থেকে কমপক্ষে দেড় মিটার দূরে ভবন নির্মাণ করতে হবে। অর্থাৎ ভবন বানাতে গিয়ে কোনোভাবেই প্রতিবেশীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করা যাবে না।
কোনো আবাসিক স্থানে ১০ শয্যাবিশিষ্ট ক্লিনিক, ব্যাংক, ফাস্টফুড রেস্তোরাঁ, দোকান, সেলুন, চিকিৎসকের চেম্বার, ঔষধালয়, সংবাদপত্র বিক্রয়কেন্দ্র, ফুলের দোকান, গ্রন্থাগার, নার্সারি স্কুল, লন্ড্রি ও দরজির দোকানের জন্য ভবন নির্মাণ করা যাবে। তবে এ রকম দালান কেবল দুটি রাস্তার সংযোগস্থলে নির্মাণ করা যাবে, যার মধ্যে একটি রাস্তা কমপক্ষে ছয় মিটার প্রশস্ত হতে হবে।
ইচ্ছা করলেই প্রতিবেশীর জায়গার ওপর কিংবা রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করা যাবে না। ঢাকা ও চট্টগ্রামের জন্য প্রতিটি ভবনে কমপক্ষে ২৩ বর্গমিটার জায়গা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রাখতে হবে। আর বাণিজ্যিক স্থানে সরকারি কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করে দেওয়া জায়গা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রাখতে হবে। ভবনের ছাদ এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে, যাতে ওই ছাদের পানি রাস্তায় বা অন্যের জমিতে কিংবা ভবনে না যায়। ছাদ বা কার্নিশ উন্মুক্ত স্থানের ওপর আধা মিটারের অর্ধেকের বেশি বাড়ানো যাবে না। ভবনের দরজা ও জানালার ওপর হাফ মিটার প্রস্থের বেশি সানশেড নির্মাণ করা যাবে না।
প্রতিবেশীদের বিরক্তি করা যাবে না
ঢাকাসহ অন্যান্য মহানগরে কার্যকর রয়েছে মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনগুলোতে রয়েছে সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশ। এই অধ্যাদেশগুলো অনুযায়ী, রাস্তাঘাটে কিংবা যত্রতত্র যা খুশি তা করা যাবে না। যেমন রাস্তার ওপর কিংবা লোকজন চলাচল করে এমন জায়গায় গাড়ি মেরামত করা যাবে না, যাতে প্রতিবেশীদের সমস্যা হয় কিংবা তাদের গাড়ি চলাচলে অসুবিধা হয়। শুধু হঠাৎ কোনো গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হলেই মেরামত করা যাবে।
প্রতিবেশীর বাসার সামনে ইচ্ছা করলেই পশু জবাই করা যাবে না। অনুমোদিত স্থান ছাড়া পশু জবাই করা এবং কাটাকাটি করা যাবে না। আপনার বাসার ময়লা-আবর্জনা ইচ্ছা করলেই যেখানে-সেখানে ফেলে রাখতে পারবেন না। ইচ্ছা করলেই এমনভাবে থুতু বা পানের পিক ফেলতে পারবেন না, যাতে প্রতিবেশীদের গায়ে পড়ে কিংবা চলাচলে সমস্যা হয়। ফেলতে হবে নির্ধারিত স্থানে। রাস্তার ধারে যেখানে-সেখানে ইচ্ছা করলেই মলমূত্র ত্যাগ করা যাবে না। আপনার মন চাইল, কোনো বিশেষ দিন উপলক্ষে প্রতিবেশীর বাসার সামনে কিংবা এলাকার রাস্তায় সংগীত, কৌতুক বা যেকোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করবেন। প্রতিবেশীদের বিরক্ত করে এ আয়োজন করতে পারবেন না। রাস্তায় কিংবা কোনো প্রকাশ্য স্থানে কাপড় ধোয়া যাবে না এবং গোসল করা যাবে না। কোনোভাবেই প্রতিবেশীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করা যাবে না। উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে প্রমাণিত হলে ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই বছর পর্যন্ত সাজা দিতে পারেন। আপনি ইচ্ছা করলেই অনুমোদন না নিয়ে প্রতিবেশীর বাসায় ঢুকে পড়তে পারবেন না যখন-তখন। আপনার পালিত কোনো পশু-পাখি রাস্তায় ছেড়ে রাখতে পারবেন না। প্রতিবেশীর বাসার দালানে কোনো পোস্টার বা বিজ্ঞাপন লাগানো যাবে না। সমাজে চলতে গেলে এসব বিধিনিষেধ আপনাকে মেনে চলতেই হবে। যদি না মানেন, তাহলে কমপক্ষে ১০০ টাকা থেকে শুরু করে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হতে পারে এবং এর সঙ্গে থাকা লাগতে পারে জেলেও। আইন অনুযায়ী কোনো ক্ষতিগ্রস্ত বা বিরক্তির শিকার প্রতিবেশী পুলিশের কাছে লিখিত প্রতিকার চাইতে পারেন। এ ছাড়া প্রতিবেশীর অধিকার রয়েছে টর্ট আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের মামলা করারও।
l লেখক: আইনজীবী