প্রাঙ্গণে প্রাণের বন্ধু

>

বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুত্ব সব সময়ই প্রাণবন্ত। স্বপ্ন নিয়ের আয়োজনে মডেল হয়েছেন তাজওয়ার, শিলু, তানভীর, মেঘলা, শমী ও রাগীব। ছবি: খালেদ সরকার
বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুত্ব সব সময়ই প্রাণবন্ত। স্বপ্ন নিয়ের আয়োজনে মডেল হয়েছেন তাজওয়ার, শিলু, তানভীর, মেঘলা, শমী ও রাগীব। ছবি: খালেদ সরকার

আগস্ট মাসের প্রথম রোববার—এই সমীকরণ মেনে, আজ বন্ধু দিবস। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পড়ালেখা করতে এসে আমাদের বন্ধুর তালিকায় যোগ হয় কত মুখ! এই বন্ধুত্ব চিরকালই অন্য রকম, অনন্য। লিখেছেন প্রণব ভৌমিক

বন্ধু জিনিসটা যে কী, সেটা বুঝতে বুঝতেই বেজে যায় স্কুলের শেষ ঘণ্টাটা। কে আসলে বন্ধু, বন্ধুর দরকারই বা কী—এমন ভাবনার বয়সও তো হয় না। কত বন্ধু হারিয়ে যায় এভাবে! ক্লাস থ্রিতে বা ফাইভে, কিংবা সেভেনে যাদের পাশের সিটে বসা ছিল রীতিমতো নিয়ম, সেসব বন্ধু আজ কোথায়?

আর কলেজের বন্ধুত্ব? মোটে তো দেড়টা বছর। বন্ধুত্ব শুরু হতে না-হতেই শেষ। ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। তবু মোটা দাগে, স্কুল-কলেজের বন্ধুরা হারিয়ে যায়। সায়ানের একটা গানের কথায় আছে, ‘কেন বাড়লে বয়স ছোটবেলার বন্ধু হারিয়ে যায়?’

এমনই হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছড়াতে থাকে বন্ধুরা। পাল্টাতে থাকে বন্ধুদের পরিবেশ, সেই সঙ্গে পাল্টাতে থাকে মানসিকতা। বন্ধুত্বের বাঁধনটাও হয়ে যায় নড়বড়ে। শেষ পর্যন্ত কেবল থেকে যায় মাঝেমধ্যে ফেসবুকে হাই, হ্যালো!

তবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন মানেই অদ্ভুত সব বন্ধুত্বের গল্প। মানে আড্ডা, মানে প্রাণখুলে গান, মানে হইচই, তর্কবিতর্ক। কত ঝগড়া, রেষারেষির পর আবার গলাগলি। ফার্স্ট ইয়ারে ক্লাসের সবাই বন্ধু, আস্তে আস্তে সেটা সীমাবদ্ধ হয় পাঁচ-ছয়জনের গ্রুপে। একসঙ্গে ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, গ্রুপ স্টাডি, বিকেলবেলায় আড্ডা, এখানে-সেখানে ঘুরতে যাওয়া, রাত জেগে ক্যাম্পাসে বারবিকিউ আয়োজন—সবই চলে।

ছেলে আর মেয়ের বন্ধুত্ব এখন যতটা সাধারণ ব্যাপার, সেটা সব সময় এমন ছিল না। ছেলে-মেয়েতে নিখাদ বন্ধুত্ব হতে পারে, এটাই বিশ্বাস করা হতো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই ধরা যাক। রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সন্‌জীদা খাতুন তাঁর আত্মজীবনী সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দেতে জানাচ্ছেন, ১৯৫২ সালে ভর্তির আবেদনপত্র পূরণ করতে গিয়ে দেখেন, সেখানে অনেক শর্ত। তার মধ্যে একটি, ছেলে আর মেয়ে কথা বলতে পারবে না! বিশেষ প্রয়োজনে কথা বলতে হলে প্রক্টরের কাছে আবেদন করতে হবে। আর কেউ যদি এই শর্ত না মানত, জরিমানা দিতে হতো তাকে। সেসব বাধা পরে মানেনি কেউই। ছেলে-মেয়ে মিলে পুরো ষাট ও সত্তরের দশকে কত আন্দোলন হলো এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই।

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের লেখায় পাওয়া যায় বন্ধুত্বের আরেক অনাবিল আনন্দের কথা। সদ্য স্বাধীন হয়েছে দেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম র‍্যাগ ডে পালন করা হচ্ছে সূর্য সেন হলের নেতৃত্বে। এখন র‍্যাগ ডের জন্য সবাই আলাদা টি-শার্ট বানিয়ে নেয়। তখন শার্ট নষ্ট করা ছিল বিলাসিতা। তবু বন্ধুত্বের উদ্‌যাপন তো করতে হবে। সেদিন সৈয়দ মনজুরুলের বন্ধুরা সবাই একে অন্যের গায়ে রং মেখেছেন ঠিকই। তবে এমন রং যা পরে ধুয়ে ফেলা যায়। সেসব দিনের কোনো ছবিই তোলা হয়নি। এখনকার মতো সবার কাছে ক্যামেরা তো ছিল না।

এরপরে একটা সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য বারবার বন্ধ হয়ে যেত। বন্ধ তো বন্ধই, মাসের পর মাস খোলার নাম নেই। তখন ফেসবুক ছিল না, মোবাইলও না। ল্যান্ডফোনে কথা বলাও হতো না তেমন। বন্ধুদের দেখা পেতে মন তাই ছটফট করত। কে কোন বইটা পড়ল, কোন সিনেমাটা দেখল নতুন, কোথাও কেউ ঘুরতে গেল কি না—অনেক দিন পর দেখা হলে সেসব নিয়েই চলত কয়েক দিন আলোচনা। আর এখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফেসবুকে আপডেট মিলছে। বন্ধুর জন্য সেই আকুলতা কি আর আছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া নাফিজ মুন-ইম যেমনটা বললেন, ‘হ্যাঁ, এটা ঠিক, একটা যোগাযোগ থাকে। আবার মিসও করি বন্ধুদের।

‘ছুটি থেকে হলে ফেরার পর বিভিন্ন জেলা থেকে একেকজন বন্ধু আসতে থাকে। সঙ্গে বন্ধুরা নিয়ে আসতে থাকে মায়েদের রান্না করা খাবার। তখন হলে সেই আমেজের কোনো তুলনা নেই।’

আবার কারও জন্য রক্ত দরকার? ‘বন্ধুদের কেবল বললেই হয়। খুব ভালো সাড়া পাওয়া যায়।’—নাফিজই বললেন।

বন্ধুত্ব ব্যাপারটা কতটা জরুরি, এ বোধ হয় যারা বিদেশে পড়াশোনা করতে যায়, তারাই ভালো বুঝতে পারে। ভিনদেশে তাই তারা বন্ধুদের অ্যাসোসিয়েশন বানায়। একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে গেছেন, সেই রুশফেরত বন্ধুরা আজও নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, মিলিত হয়ে আড্ডা দেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনের বগিতেও কত বন্ধুত্বের শুরু। শাটলের বগির দেয়াল চাপড়িয়ে একদল শিক্ষার্থী মুখর রাখে চট্টগ্রাম শহর থেকে ক্যাম্পাসের পুরো যাত্রাপথ। প্রতি ব্যাচেই এমন বগিশিল্পী বন্ধুদের দেখা যায়। নকীব খান, পার্থ বড়ুয়া, এস আই টুটুলরাও একসময় ছিলেন এসব দলে।

সংগীতশিল্পী পার্থ বড়ুয়া বলেন, ‘ট্রেনের একটা জায়গা ছিল ককপিট। ওইখানটায় একটা আড্ডা হতো। ফার্স্ট বা সেকেন্ড ইয়াররাই বসত বেশি। সিনিয়র ব্যাচ একসময় জুনিয়রদের কাছে দিয়ে দিত জায়গাটা। আবার বগিতে গান হতো। কিছু গান সিনিয়রদের থেকে আমরা শিখেছি, আমাদের থেকে জুনিয়ররা শিখেছে। ইউনিভার্সিটিতে খোলা থাকুক বা বন্ধ, যেতেই হবে—এমন একটা ব্যাপার ছিল।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুত্ব সম্পর্কে পার্থ বড়ুয়া বলেন, ‘এ সময়ের বন্ধুত্বটাই অন্য রকম। ওই সময়টায় মানুষ ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে শুরু করে, একধরনের ম্যাচিউরিটি আসে। সিনিয়র-জুনিয়রদের অনেকেও বন্ধু হয়ে যায়। একটা অদ্ভুত রকমের বন্ধুত্ব। পরীক্ষার আগে হলে গিয়ে থাকা, মজা করা, একসঙ্গে পড়াশোনা করা—এসব আনন্দ এখনো মিস করি। এখনো অনেক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ আছে।’