প্রেরণায় প্রিয় শিক্ষক

শিক্ষককে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকদের মধ্যেই অনেকে হয়ে ওঠেন আদর্শ ও অনুপ্রেরণা। দেশজুড়ে থাকা এমন অনন্য শিক্ষকদের খুঁজে বের করে সম্মানিত করার জন্য আয়োজন ‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা’। উদ্যোগের ২০২০ সালের আয়োজনে সম্মাননাপ্রাপ্ত নয়জন শিক্ষকের কথা পড়ুন এখানে।

২৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর একটি হোটেলে আইপিডিসি–প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০২০ পাওয়া শিক্ষকেরাহাসান রাজা

অনুপ্রেরণার উৎস শাহনাজ কবীর

শাহনাজ কবীর
সৈকত বরণ শীল

তাফসিলুল আজিজ, কিশোরগঞ্জ

‘খুব ভালো ছাত্রী’—ছেলেবেলা থেকে সবার মুখে এই প্রশংসা শুনে বড় হয়েছেন শাহনাজ কবীর। সবার আগে অঙ্ক করে খাতা জমা দিলে শিক্ষকেরা যখন তাঁকে বোর্ডে অঙ্কটা করে বুঝিয়ে দিতে বলতেন, তখন বোঝানোর পর সবাই হাততালি দিত। তিনি মনে মনে ভাবতেন, ভালোভাবে পড়া বুঝিয়ে দিলে সবাই কত খুশি হয়, কত ভালোবাসে। তাহলে আমিও শিক্ষক হব।

শাহনাজ কবীর শিক্ষকই হয়েছেন। ছাত্রজীবনে যেমন ভালো করার তাগিদ ছিল, ঠিক তেমনই শিক্ষকজীবনেও তাঁর মেধা ও দক্ষতা দিয়ে চেষ্টা করেছেন সবচেয়ে ভালো করার।
মরণব্যাধি ক্যানসারও তাঁর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তাই তো তিনি শিক্ষকদেরও অনুপ্রেরণা ও সাহস।

শাহনাজ কবীরের জন্ম ১৯৭০ সালের ১৮ মার্চ। ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর শেষে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (মহিলা), ময়মনসিংহ থেকে প্রথম শ্রেণিতে বিএড এবং এমএড ডিগ্রি অর্জন করেন। আর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি) পদে যোগ দেন ১৯৯৭ সালে। প্রথম কর্মস্থল ছিল নোয়াখালী জিলা স্কুল।

২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে সরাসরি সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে। পরের বছর কিশোরগঞ্জ শহরের এস ভি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে বদলি হন। পদোন্নতি পেয়ে ২০১০ সালে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক হন।

প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১২ ও ২০১৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় ফলাফলে এস ভি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় জেলার সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে। ‘জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ২০১৯’ উপলক্ষে তাঁকে দেশের সেরা প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।

শাহনাজ কবীর বলেন, ‘আমার শরীরে ক্যানসার বাসা বেঁধেছে। এর মধ্যে আমার অস্থিমজ্জা (বোনম্যারো) প্রতিস্থাপন করানো হয়েছে। তবু মনে সাহস রেখেছি। রোজ স্কুলে যাই। ছাত্রীদের মায়াভরা মুখগুলো, সহকর্মীদের ভালোবাসা এবং অভিভাবকদের সান্ত্বনা আমাকে অসুস্থতার কথা ভুলিয়ে দেয়।’

শিক্ষার্থীদের পাশে থাকেন তিনি

রহিমা খাতুন

কামনাশীষ শেখর, টাঙ্গাইল

রহিমা খাতুন কেবল শিক্ষার্থীদের পড়ান তা নয়, শিক্ষার্থীদের যেকোনো সমস্যায় পাশে দাঁড়ান তিনি। বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা, বয়ঃসন্ধিকালে ছাত্রীদের সমস্যার সমাধানসহ যেকোনো বিষয়েই শিক্ষার্থীরা পাশে পায় তাঁকে। রহিমা খাতুনের জন্ম টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার গোয়ারিয়া গ্রামে। নিজ উপজেলার আউলিয়াবাদ মাজার দাখিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন ১৯৯৬ সাল থেকে।

আপনি যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এত জনপ্রিয়, এর মূলমন্ত্র কী? প্রশ্ন শুনে রহিমা খাতুন বলেন, ‘শুরুর দিকে লক্ষ করি, প্রতিবছর মাদ্রাসার অনেক ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়ে যায়। ফলে তাদের লেখাপড়া বন্ধ হয়। তাই শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করি, যাতে লেখাপড়া বন্ধ করে অপ্রাপ্তবয়সে সন্তানকে বিয়ে না দেন। কোনো শিক্ষার্থীর বিয়ের উদ্যোগ নেওয়ার খবর পেলে ছুটে যাই অভিভাবকদের কাছে। তাঁদের বুঝিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ করি। বুঝিয়ে বন্ধ করতে না পারলে প্রশাসনের সহায়তা নিই।’ এভাবে তাঁর উদ্যোগে অন্তত ২৫ জন ছাত্রী বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

রহিমা খাতুনের স্বামী আবুল হাশেমও একই মাদ্রাসার শিক্ষক। এক ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে সংসার। রহিমা খাতুন বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা আমার নিজের সন্তানের মতো। তাই শুধু পড়াশোনা নয়, ওদের যেকোনো সমস্যায় পাশে থাকার চেষ্টা করি।’

‘স্যার কখনো বসে বসে পড়াতেন না’

আবদুর রশিদ

মনিরুল ইসলাম, যশোর

তাঁর ছাত্রদের ভাষায়, ‘রশিদ স্যার কখনো বসে বসে পড়াতেন না।’ আদতেই তা-ই, ক্লাসে পড়ানোর সময় মো. আবদুর রশিদ কখনোই চেয়ারে বসতেন না। ক্লাসে ঘুরে ঘুরে গল্পের ছলে পড়া বুঝিয়ে দিতেন। মো. আবদুর রশিদ ঝিকরগাছা সরকারি এম এল মডেল হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।

শিক্ষক আবদুর রশিদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও। তাঁর প্রাক্তন ছাত্র এ কে এম শাওন কাদির বলছিলেন, ‘ক্লাসে রশিদ স্যার প্রতিটি বেঞ্চে একটা করে দল তৈরি করে দিতেন। একটা অধ্যায় পড়ার পর ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্ন বানিয়ে প্রতিটি দলকে উত্তর লিখতে বলতেন। লেখার পর গ্রুপ থেকে একজনকে সামনে নিয়ে সেটা আবার পড়তে বলতেন। ক্লাসে সেই গ্রুপকে আবার নম্বর দিতেন। পড়ানোর এই পদ্ধতিটি দারুণ ও আধুনিক।’

আবদুর রশিদের পড়ানোর এই আধুনিক কৌশল, তাঁর পাণ্ডিত্যের প্রশংসা করেন সবাই। কেবল ছাত্রছাত্রীই নয়, শিক্ষকদের কাছেও তিনি আদর্শ। এখনো সমাজের উন্নয়নে, পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে তাঁকে পাওয়া যায় সামনের সারিতেই।

টানা ৪০ বছর শিক্ষকতা করেছেন। বয়স এখন ৭০ ছুঁই ছুঁই। সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। দুই আলমারিভর্তি বই দেখে বুঝতে অসুবিধা হয়নি অবসরে নিয়মিত ডায়েরি লেখার পাশাপাশি বই পড়েন তিনি। তাঁর লেখা ২০টি ডায়েরিও সাজানো আছে সেখানে। আছে তাঁর লেখা বইও।

বটবৃক্ষের মতো শিক্ষক

ফয়েজ আহমদ

এস এম হানিফ, চকরিয়া, কক্সবাজার

শিক্ষার্থীরা ভালো করুক, তা মনেপ্রাণে চাইতেন মো. ফয়েজ আহমদ। এ জন্যই শ্রেণিকক্ষের নিয়মিত পাঠদানের বাইরে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করেন বিশেষ পাঠদান। এই বিশেষ পাঠদানের কারণে বিদ্যালয়টি উপজেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়।

ফয়েজ আহমদের জন্ম ১৯৫৭ সালে কক্সবাজারের চকরিয়া পৌরসভার বিনামারায়। ১৯৮০ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে হাজিয়ান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন তিনি। পরবর্তী সময় চকরিয়ার আরও কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছে। এসব স্কুলে সকাল-বিকেল দুই পর্বে বিশেষ পাঠদান করে সুনাম কুড়ান মো. ফয়েজ আহমদ।

সুনাম ছড়িয়ে পড়ার পর ফয়েজ আহমদ বদলি হয়ে আসেন কাহারিয়াঘোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এই স্কুলে যোগ দিয়েই ফয়েজ আহমদ শুরু করেন নতুন অভিযান। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করেন সান্ধ্য কোর্স। ১৯৯০ সাল থেকে স্কুলটি থেকে প্রতিবছরই এক থেকে চারজন পর্যন্ত বৃত্তি পেতে থাকে। ১৯৯৬ সালে পাঁচজন ট্যালেন্টপুলে ও পাঁচজন সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পায়। ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি এই বিশেষ পাঠদান চালু রেখেছিলেন। ২০১৭ সালে অবসরে যান ফয়েজ আহমদ।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আমান উদ্দিন বলেন, ‘ফয়েজ স্যার আমার শিক্ষক।
তাঁর মতো শিক্ষার্থীদের পাঠদানকে “ঘরসংসার” মনে করার মতো শিক্ষক এখনো পাইনি। তাঁর জীবনের বড় অংশ ব্যয় করেছেন শিক্ষার্থী ও স্কুলের জন্য।’

সহশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আপন

আফরূজ জাহান বেগম

মো. নূরুজ্জামান, ঢাকা

আফরূজ জাহান বেগমের মা ছিলেন শিক্ষক। একসময় তিনিও ঠিক করেন, মায়ের আদর্শেই জীবন চালাবেন, বেছে নেবেন মায়ের পেশা—শিক্ষকতা।

১৯৮১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুস সামাদ খানের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন আফরূজ জাহান বেগম। স্বামীর কর্মস্থল ময়মনসিংহে শুরু হয় সংসারজীবন। পড়াশোনাও চালিয়ে নেন। ময়মনসিংহের দুটি স্কুলে শিক্ষকতার পর সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হাইস্কুলে। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলোর দিকে আমি জোর দিতাম বেশি। দেয়ালপত্রিকা, বিতর্ক, ছবি আঁকা, বই পড়া কর্মসূচিতে নিজে উপস্থিত থেকে তদারক করতাম। এসব সহশিক্ষা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে স্কুলের সুনাম বাড়ে। বেশি উপকৃত হয় শিক্ষার্থীরা।’

আফরূজ জাহান বেগমের জন্ম বগুড়া শহরে। বাবা ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর অফিসের হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা এবং মা ছিলেন বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষক। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। আফরূজ জাহান অবসর নিয়েছেন ২০১৭ সালে। লেখালেখির অভ্যাস এখনো রয়েছে। সহকর্মীদের কাছ থেকে এখনো স্কুলের বাগানের চারা গাছ আর শিক্ষার্থীদের খোঁজ নেন ঠিকই।

এখনো পড়াতে চান দেবী রানী দাশ

দেবী রানী দাশ

শাহাদৎ হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

আর্থিক সমস্যায় পড়াশোনা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন জয়দেব। শিক্ষক দেবী রানী দাশ বিষয়টি জেনে ছাত্র জয়দেবের বাড়ি গেলেন। বোঝালেন—পড়াশোনার গুরুত্ব। সহায়তাও করলেন। জয়দেব এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার অরুয়াইলে একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। তিনি বলছিলেন, ‘সেদিন যদি ম্যাডাম বাড়িতে না যেতেন, তাহলে আজ আমি স্নাতকোত্তর হতে পারতাম না।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দেবী রানী দাশ সম্পর্কে এমন আরও অনেক কথা শুনবেন আপনি। স্কুল আর ছাত্রছাত্রীই ছিল তাঁর পৃথিবী। বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের খোঁজ নেওয়া, ক্লাসের সময় শেষ হয়ে গেলে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পড়া বুঝিয়ে দেওয়া ছিল তাঁর নিয়মিত কাজ।

১৯৮৭ সালে শিক্ষকতা শুরু করেন দেবী রানী। গোকর্ণ পশ্চিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নেন ২০০০ সালে। আর ২০১৩ সালে ওই স্কুল থেকে বদলি হয়ে সিলেটের একটি বিদ্যালয়ে যান। সেখান থেকেই অবসরে গেছেন ২০১৯ সালে।

দেবী রানী দাশ বলেন, ‘সেবার মানসিকতা নিয়ে শিক্ষকতা করেছি। শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানের মতো করে আদর করতাম। এখনো ইচ্ছা করে, আবার যদি স্কুলে পড়াতে পারতাম।’

যিনি সবার আদর্শ

করিমা খানম

শাহ আলম, চুয়াডাঙ্গা

করিমা খানমের জন্ম ১৯৫২ সালের ১৭ জানুয়ারি দামুড়হুদার কুড়ুলগাছিতে। সেই গ্রামে তখন স্কুল ছিল না। পড়াশোনা ছিল মক্তবনির্ভর। মেয়ের পছন্দে পাশের গ্রামের ধান্যঘরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক্-প্রাথমিকে ভর্তি করান বাবা শাহ মোহাম্মদ আবদুল করিম। সেখান থেকে পঞ্চম শ্রেণির চৌকাঠ পেরোন করিমা। তারপর ভর্তি হন বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরের দর্শনা বালিকা বিদ্যালয়ে। সেখানে যেতে হতো গরুর গাড়িতে করে। রীতিমতো নিত্যদিনের যুদ্ধ! দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় আলমডাঙ্গার খোন্দকার শামসুল হুদার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়। পড়াশোনা ও চাকরির শর্তে রাজি হন করিমা। নতুন জীবন সামলে ঠিকই ম্যাট্রিকুলেশনে (বর্তমানের এসএসসি) উত্তীর্ণ হন তিনি। তারপর উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন আলমডাঙ্গা কলেজ থেকে। মজার বিষয় হলো, ১৯৯৫ সালে তিনি স্নাতক (পাস) সম্পন্ন করেন ছেলে তৌহিদের সঙ্গে।

১৯৭০ সালে আলমডাঙ্গা মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করেন করিমা। আর প্রধান শিক্ষক পদে দামুড়হুদা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন ২০০৪ সালে। ২০০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি অবসরে যান তিনি। অবসরে যাওয়ার আগে তাঁর নেতৃত্বে দামুড়হুদা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পেয়েছে তিনবার বিভাগীয় সেরা ও ২০০৭ সালে দেশসেরা বিদ্যালয়ের পুরস্কার।

পিছিয়ে পড়াদের প্রেরণা

মো. জমিউল করিম

আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, রাজশাহী

দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফি ছাড়া সব ফি মওকুফ করেছিলেন মো. জমিউল করিম। শিক্ষার্থীরা যাতে ঝরে না পড়ে, সে জন্য নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাবা-মায়েদের বোঝাতেন। সে সময় বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর বাড়িতেই বিদ্যুৎ ছিল না। তাই সন্ধ্যার পর পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের স্কুলে পড়ার সুযোগও করে দিয়েছিলেন তিনি। এ কাজের জন্য কয়েকজন শিক্ষককে দায়িত্ব দিতেন। শুধু তা-ই নয়, যারা বই কিনতে পারত না, তিনি নিজের লাইব্রেরি থেকে তাদের বিনা পয়সায় বই দিতেন। যারা প্রাইভেট পড়তে পারত না, তাদের আলাদাভাবে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করেছিলেন।

মো. জমিউল করিম রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পিরিজপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৮৯ সালে। মিরু স্যার হিসেবে সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নিয়েছেন ২০১৮ সালে।

মো. জমিউল করিমের উদ্যোগের কারণে পিছিয়ে পড়া অনেক শিক্ষার্থী প্রভূত উপকার পেয়েছিল। তাঁর এক শিক্ষার্থী মো. শফিউল্লাহ বলেন, ‘নবম শ্রেণিতে আর্থিক সমস্যার কারণে সেশন ফি দিতে পারিনি। সে জন্য হাজিরা খাতায় আমার নাম ছিল না। একদিন স্যার
প্রথম ক্লাসে নাম ডাকার সময় বুঝতে পেরে বকেয়া ফি মাফ করার ব্যবস্থা করলেন। তবে শর্ত
দিলেন ভালোভাবে পড়ার। স্যারের অনুপ্রেরণাতেই আজ আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হতে পেরেছি।’

তিনি বাতিঘর

মো. আবুল হোসেন

গাজীউল হক, কুমিল্লা

১৯৬২ সালের কথা। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের গণপূর্ত বিভাগের কার্য সহকারী পদে ১১০ টাকা বেতনে চাকরি নেন মো. আবুল হোসেন। কিন্তু ওই চাকরিতে ঠিকাদারেরা প্রায়ই ঘুষ সাধতেন। তাই ত্যক্তবিরক্ত হয়ে শেষমেশ এক বছর পর চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর যোগ দেন ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুরের বারভাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে। এরপর ১৯৬৯ সালে সপরিবার চলে আসেন বাংলাদেশের কুমিল্লায়। এখানে থিতু হয়ে আবার সেই শিক্ষকতা পেশাই বেছে নেন তিনি। কুমিল্লা মডার্ন স্কুলের শিক্ষক মো. আবুল হোসেন এপার-ওপার দুই বাংলাতেই শিক্ষকতা করে পেয়েছেন আনন্দ আর সম্মান। তাঁর ভাষায়, ‘শিক্ষকতাই আমার ধ্যানজ্ঞান।
আনন্দহীন কর্ম ব্যর্থ কর্ম। আনন্দহীন শিক্ষা ব্যর্থ শিক্ষা।’

মো. আবুল হোসেন কুমিল্লা মডার্ন স্কুলে (প্রাথমিক বিদ্যালয়) সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দেন ১৯৭০ সালে। চাকরির পাশাপাশি পড়াশোনা শুরু করেন আবার। ১৯৭২ সালে কুমিল্লা সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও ১৯৯১ সালে ডিগ্রি (বিএ) পাস করেন। ২০১৪ সালে পদোন্নতি হয় তাঁর, দায়িত্ব পান সহকারী প্রধান শিক্ষকের। টানা ৫০ বছর ধরে জ্ঞানের আলো বিতরণ করছেন নিরলসভাবে।

প্রিয় শিক্ষক মো. আবুল হোসেন সম্পর্কে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ আঞ্জুম সুলতানা বলেন, ‘শিক্ষকতায় স্যার নিবেদিতপ্রাণ। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সারা দিন মেতে থাকেন।’