
রাত তখন গভীর। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আহসানউল্লাহ হলের গেটের পাশে তাঁর সঙ্গে দেখা। ইউনিফর্ম দেখে বোঝা গেল তিনি হলের নৈশপ্রহরী। আপন মনে কী যেন লিখে চলেছেন। কাগজ-কলমের পাশে এক গাদা পত্রিকা আর একটা বাংলা অভিধান। নাম জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, এস এম ফরিদউদ্দীন।
সেই রাতেই বেশ কিছুক্ষণ কথা হয় ফরিদউদ্দীনের সঙ্গে। কথায় কথায় জানা গেল, তিনি প্রায় নয় বছর ধরে এই হলে নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্ব পালন করছেন। মজার ব্যাপার হলো এর মধ্যে আট বছর ধরে তিনি শুধু রাত্রিকালীন ডিউটি করেছেন। কারণ একটাই, ‘রাতের বেলা পড়াশোনা ও লেখালেখির কাজ অনেক মনোযোগ দিয়ে করা যায়।’ কবিতা লেখায় ঝোঁক। সেই কবিতা লিখতে লিখতেই এবারের বইমেলায় ফরিদউদ্দীন চমক দেখিয়েছেন। তাঁর একটি কবিতার বই বেরিয়েছে। কবিতার মধ্যে বর্ণমালা নিয়ে রীতিমতো খেলা দেখিয়েছেন বলেই কিনা তাঁর বইয়ের নাম ‘বর্ণের খেলাঘর’।
কিশোরগঞ্জের পাঁচধা গ্রামে জন্ম ফরিদউদ্দীনের। ছোটবেলা কেটেছে অভাবে-অনটনে। ফরিদউদ্দীনের বয়স যখন তিন মাস, তাঁর বাবা তখন নতুন বিয়ে করেন। মামার বাড়িতে বড় হয়েছেন। কোনো রকমে মাধ্যমিক পাস করার পরে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজে। তবে অভাব-অনটনের কারণে এক বছর পরেই কলেজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে যোগ দেন এই হলে।
কবিতা লেখায় আগ্রহী হলেন কখন? ফরিদউদ্দীন বলেন, ‘হলে চাকরি নেওয়ার পর তৎকালীন ছাত্র মেহেদী ও শুভ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে প্রায়ই নাটক দেখতে যেতাম। তাঁরা তখন আমার আগ্রহ দেখে পরামর্শ দেন নিজের থেকে কিছু লেখার। তবে লেখার আগে আরও বেশি জানতে হবে। আর তার জন্য পড়তে হবে।’ ব্যস! তারপর থেকেই ফরিদউদ্দীনের বাংলা ভাষা নিয়ে লেগে থাকা, পড়াশোনা করা। তাঁর এই লেগে থাকা দেখে কবিতা লেখার পরামর্শ দেন তাঁর বন্ধু নূরুল ইসলাম।
শুরু করলেন ‘মুক্তিযোদ্ধা জঁ ক্যা’ নামের একটি কবিতা দিয়ে। এই কবিতা লিখতে নাকি তাঁর সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে তিন বছর। কবিতাটিতে তিনি বাংলা বর্ণমালার ৫০টি বর্ণ মাত্র একবার ব্যবহার করেছেন। বোঝাই যাচ্ছে এটা মোটেও সহজসাধ্য কাজ ছিল না। এমন আরেকটি কবিতা ‘বর্ণমালায় একুশ’। বাংলা বর্ণমালার বর্ণগুলো পর্যায়ক্রমে প্রথম অক্ষরে রেখে তিনি লিখেছেন। আর শব্দসংখ্যা রেখেছেন ঠিক ৫২টি। একইভাবে ‘বর্ণমালায় একাত্তর’, ‘বর্ণে বর্গে বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘বর্ণমালায় বীরশ্রেষ্ঠ’ কবিতায়ও একই ধরনের ভাষারীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, শব্দসংখ্যা রেখেছেন ঠিক একাত্তরটি। এসব ছাড়াও শুধু ‘আ-কার’, ‘এ-কার’, ‘ই-কার’, ‘উ-কার’ দিয়ে সব শব্দ শুরু হয় এমন কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন বাংলা ভাষায় প্যালিনড্রোম কবিতা (একই লাইনে বাঁ থেকে এবং ডান থেকে পড়লে যার অর্থ একই দাঁড়ায়)।
ফরিদউদ্দীন তাঁর লেখা কবিতা নিয়ে বলেন, ‘বর্ণ কীভাবে শব্দের মধ্যে খেলা করে আর শব্দ কীভাবে কবিতার প্রতিটি লাইনে খেলা করে তার একটি ছোটখাটো রূপ দিতে চেষ্টা করেছি। আশা করি, সর্বস্তরের পাঠকের কবিতাগুলো ভালো লাগবে।’ তবে এখানেই থামতে চান না তিনি। বাংলা ভাষার প্রতি এই আগ্রহকে পুঁজি করেই লেখালেখির কাজ এগিয়ে নিতে চান বহুদূর।