ফাইনাল ইয়ারে উইঠা আমার...

আঁকা: রাজীব
আঁকা: রাজীব

ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে এসে সবাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, আবার যদি স্কুলে ফিরে যেতে পারতাম! আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভেবেছিলাম, ইশ্‌, কবে যে ফাইনাল ইয়ারে উঠব! ফাইনাল ইয়ারে উঠতে চাওয়ার পেছনে কারণ একটাই। দীর্ঘ ২০ বছর লেখাপড়া করার পর আমার মনে হচ্ছিল, যথেষ্ট বয়স হয়েছে; এই জিনিস আর না। কবি সুকান্ত ২১ বছর বয়সে পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে মারা গেছেন আর আমি কিনা ২০ বছর বয়সে এসে একটা ডিগ্রির জন্য রাত জেগে পড়াশোনা করছি! এটা কোনো লাইফ হলো!
সেই থেকে আমি দিনরাত একটাই স্বপ্ন দেখতাম, এমন একদিন আসবে, যেদিন আর মাথার ওপর পরীক্ষা, ল্যাব রিপোর্ট, ক্লাস টেস্ট—এসব ঝামেলা থাকবে না। সিনিয়র ভাইদের কাছ থেকে জেনেছিলাম, ফাইনাল ইয়ারে কোনো ল্যাব নেই, কোর্সও অনেক সহজ। ভেবে দেখলাম, এটাই আমার জন্য বেস্ট। ফাইনাল ইয়ার এমন একটা ইয়ার, যেখানে গিয়ে ইচ্ছেমতো সহজ কোর্স পড়া যাবে, ল্যাব রিপোর্ট লিখতে হবে না, কিছুদিন পর চাকরি পাব— মনকে এই বুঝ দিয়ে মা-বাবাকেও ম্যানেজ করা যাবে। ইচ্ছেমতো আমি আমার ডিরেক্টরগিরি চালিয়ে যেতে পারব। ফেল করলেও সমস্যা নেই। ফাইনাল ইয়ার থেকে তো কেউ থার্ড ইয়ারে নামিয়ে দিতে পারবে না!
|তাই নিজের যুক্তি আর প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে দিন পার করতে লাগলাম। ক্লাস টেস্ট, ল্যাব রিপোর্ট, অ্যাসাইনমেন্ট...দাঁতে দাঁত চেপে এসব সহ্য করি আর কোনো রকমে সময় বের করে শর্টফিল্ম বানাই। ফিল্মের পাল্লায় পড়ে থার্ড ইয়ারে একটা সাবজেক্টে ফেলও করে বসলাম। মনকে বুঝ দিলাম, বড় ফিল্ম ডিরেক্টর হতে গেলে এ রকম দু-চারটা ফেল থাকতে হয়! ফাইনাল ইয়ারে তো কাজকর্ম নেই, তখন পরীক্ষা দিয়ে পাস করা যাবে। তা ছাড়া ফেইলিওর ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস!

দেখতে দেখতে ফাইনাল ইয়ারে উঠে পড়লাম। ফাইনাল ইয়ারে উঠে সত্যিই আমি বিস্মিত, খুশিতে আত্মহারা। এই দিনটার জন্য কত দীর্ঘ দিন, দীর্ঘ রাত অপেক্ষা করেছি। সেসব নিয়ে আবেগমাখা একটা পোস্ট লিখলাম ফেসবুকে। লাইক-কমেন্টের বন্যা বয়ে গেল। সবাই অভিনন্দন জানাল ফাইনাল ইয়ারে ওঠার জন্য। আমিও ভাবলাম, এবার জীবনের একটা গতি হলো। এখন থেকে আমি হব ফুলটাইম ডিরেক্টর, পার্টটাইম স্টুডেন্ট! কিন্তু এক সুন্দর সকালে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি, ফাইনাল ইয়ারের সাত মাস চলে গেছে এবং আমি এখনো কিছুই হতে পারিনি। এদিকে সকাল ১০টা বেজে গেছে। প্রথম ক্লাস ছিল ৮টায়। আজও লেট, দূর! বিছানা ছেড়ে কোনো রকমে ক্লাসে গেলাম। সিটে বসতে না-বসতেই পাশের বন্ধু জানাল, ১২টায় ক্লাস টেস্ট আছে, পরপর দুটি! কথা শুনে আমার বারোটা বেজে গেল। বাংলা সিনেমার মাথায় বাড়ি খাওয়া নায়কের মতো আমারও মনে পড়ল, গত ক্লাসেই স্যার বলেছিলেন, আজ ক্লাস টেস্ট নেবেন। হায় খোদা, সে কথা গত রাতে মনে পড়েনি কেন? কাল যখন জনৈক আঁতেল বন্ধুর সঙ্গে বাংলা সিনেমার অন্ধকার ভবিষ্যৎ এবং শাকিব-অপু যুগের উত্থান নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করে দোকানে চায়ের বিল বাড়াচ্ছিলাম, তখন কেন মনে পড়ল না ক্লাস টেস্টের কথা!

একসময় ক্লাস টেস্ট শেষ হলো। টেস্ট শেষে স্যার নতুন শিট ধরিয়ে দিলেন। দুই মাস আমাদের ইন্টার্ন করতে হবে, কে কোথায় করবে তারই বিস্তারিত বর্ণনা। তার মানে আমার ফিল্ম বানানো দুই মাসের জন্য বন্ধ!

দুই মাস পর ইন্টার্নও শেষ হলো। আবার ক্লাস শুরু হয়েছে। আবার শুরু হয়েছে ক্লাস টেস্ট, সঙ্গে থিসিস নামক অদ্ভুত এক ব্যাপার। এই থিসিসের ওপর নির্ভর করছে ডিগ্রি পাব কি না! কী সর্বনাশ, ফিল্ম বানানো আবারও বন্ধ হলো।

এদিকে ফেসবুকে ‘উড়া খবর’ শুনছি, অমুক ফ্রেন্ডের চাকরি হয়েছে অমুক গ্রুপে, স্টার্টিং ৪০ হাজার! মনকে বুঝ দিই, তোকে ফিল্ম ডিরেক্টর হতে হবে, এসব চাকরিবাকরি দুই দিনের। মন বুঝ মানে না। থিসিসের এক ফাঁকে সিভি বানাই। গুটি গুটি পায়ে গিয়ে হাজির হই টিভি চ্যানেলের এক ভাইয়ের কাছে। চাকরি দেবেন বলে যিনি অতীতে আশ্বস্ত করেছিলেন। সিভি দেখে তিনি হতাশ, ‘তোমার তো এখনো পড়াই শেষ হয়নি, আগে পড়া শেষ করো, রেজাল্ট ভালো করো।’

রেজাল্ট শব্দটা শুনেই মাথায় আসে আমার এখনো ফেল সাবজেক্ট পাস করা বাকি! রুমে গিয়ে ভাবতে বসি, ক্লাস, ক্লাস টেস্ট, থিসিস, ভাইভা, বন্ধুদের চাকরিপ্রাপ্তি, ফেল সাবজেক্ট—মাথা হ্যাং হয়ে যায়। ফিল্ম বানানো একটু সাইড করে রাখি। সামনের মাসে ফেল সাবজেক্টটা পাস করতেই হবে। এবার পাস না করলে ডিগ্রি আটকে দেবে! হতাশা কাটাতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই, ‘বন্ধুরা যখন চাকরিতে ঢুকছে আমি তখন ফেল সাবজেক্টের পরীক্ষা দিচ্ছি। হায় রে ফাইনাল ইয়ার!’

কলিকালের এক গুণী ব্যক্তি বলেছিলেন, ‘ফেসবুকে আপনজনদের ব্লক করো, না হলে বিপদ আসন্ন।’ তাঁর কথামতো আমি ভাইয়া আর আপুকে ব্লক করে রেখেছিলাম। তাই এখনো সমস্যায় পড়িনি। তবে ফ্রেন্ডলিস্টের এক কোনায় যে দুলাভাই লুকিয়ে ছিলেন, সেটা খেয়াল করিনি কখনো। সেই দুলাভাই স্ট্যাটাসের মানে কী বুঝলেন কে জানে। আপাকে বললেন, ‘তানভীর তো ফেল করেছে! এখনো ফাইনাল ইয়ারে উঠতে পারে নাই।’ ব্যস, আর কী লাগে! এলাকায় গুজব রটে গেল, ‘তানভীর—ওই যে এলাকার সবচেয়ে ভালো ছাত্র, সে তো ঢাকায় গিয়ে ফেল করছে। একেবারে উচ্ছন্নে গেছে ছেলেটা।’

আম্মা ফোন করে বলল, ‘সত্যি করে বল, তুই ফেল করছিস?’

বললাম, ‘না, মা।’

: মিথ্যা কথা বলবি না। সত্যটা বল।

: করি নাই।

: মিথ্যা কথা বলবি না। সত্যটা বল।

: হ্যাঁ, মা, করেছি।

: আবার মিথ্যা! বল সত্যি করে, তুই ফেল করছিস?

এবার আমি দ্বিধাগ্রস্ত, সত্যিই তো বললাম নাকি! দ্বিধা কাটার আগেই আপুর ফোন, ‘তুই ফেল করতে পারলি?’

: হুঁ। তো কী হইছে, মানুষ ফেল করে না?

: তুই আমার ভাই হয়ে ফেল করতে পারলি! ইয়া খোদা, এই কথা শোনার আগে আমি অন্ধ হলাম না কেন!

আপুর আহাজারি থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আমার ফেলের উত্তেজনায় তুই ডায়ালগ গুলিয়ে ফেলেছিস, ওটা হবে এই দৃশ্য দেখার আগে আমি অন্ধ হলাম না কেন।’

বড় বোনদের ভুল ধরলে যা হয় তা-ই হলো। ঝাড়ি দিয়ে বলল, ‘ফেল করিস আবার বড় বড় কথাও বলিস! ফোন রাখ হারামজাদা...’

এভাবেই পরিবার, ফেসবুক, ক্লাস, ক্লাস টেস্ট, থিসিস, চাকরি, ফিল্ম, টিভি চ্যানেল, ভাইভা, বন্ধুর চাকরি, ফেল সাবজেক্ট...ইয়ে মানে, আমি আসলে ভুলে গেছি আমি কোন ইয়ারে উঠতে চেয়েছিলাম!