ফাগুনের ফুল

‘ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে—/ ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় রে’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফাগুনের বনকে দেখেছেন ফুলের সম্ভারে। তবে ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ ফাগুন মাস, বসন্তের প্রথম মাস। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বসন্ত ঋতুতে ফুল ফোটা নিয়ে কিছুটা দ্বিধান্বিত। তাঁর কথায় ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত...।’

ফাল্গুন মাস এসেছে কি না, তা বোঝার জন্য এ দেশের প্রকৃতিরাজ্যে একটু দৃষ্টি ফেলতেই হবে। শীতের শীর্ণ পাতাঝরা গাছের ডালে ডালে ফুলের এক অপূর্ব উন্মাদনা।
‘ফাগুনে ফুটল পলাশ/ গাছতলার মাটি দিল ছেয়ে।’ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অনেককালের একটি মাত্র দিন’ কবিতায় ফাগুনের পলাশ ফুল ধরা দিয়েছে এভাবেই। পত্রশূন্য শাখা যেমন থোকা থোকা রক্তপলাশের ফুলে ভরে ওঠে, তেমনি সেসব ঝরা ফুলে ভরে থাকে গাছের তলা। ফাগুনকে রাঙাতে এ দেশের প্রকৃতিরাজ্যে হাজির হয় জুঁই, বকুল, মাধবীলতা, মধুমঞ্জরি বা

মাধুরীলতা, কাঠচাঁপা, করবী, কনকলতা, মুচুকুন্দ, কনকচাঁপা, স্বর্ণচাঁপা, নাগকেশর, দেবকাঞ্চন, পলাশ, শিমুল, পারিজাত, পানিয়া মাদার, টগর, ভাঁটিফুল ইত্যাদি।
ফাগুনে এরূপ ফুল ভরা গাছের শোভা দেখা যায় আরও কিছু গাছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো শিমুল, দেবকাঞ্চন, পারিজাত আর কুরচি। ‘ওই যে শিমুল, ওই যে সজিনা আমারে বেঁধেছে ঋণে, কত যে আমার পাগলামি পাওয়া দিনে।’

আমাদের দেশে চেরি ফুল নেই। শীত শেষে ইউরোপের দেশগুলোতে চেরি ফুলের স্ফুরণ এক অপার্থিব আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। তেমনি আমাদের দেশে শিমুল, পলাশ আর দেবকাঞ্চন ফুলের শোভা দেখে মনটা পাগলামিতে পেয়ে বসে। রক্তলাল শিমুলভরা গাছ গ্রামীণ বনে যেন ফাগুনের আগুন ছড়িয়ে দেয়। পলাশের মতো ফুল ফোটে পারিজাতের। টকটকে উজ্জ্বল লাল থোকা ধরা ফুলের ডালে বসা বুলবুলি, শালিক—সে এক অপূর্ব স্বর্গীয় দৃশ্য ফাগুনের।

পারিজাতকে আমরা পালিত মাদার বা মান্দার বলি। কাঁটাওয়ালা ডালের এ গাছ দিয়ে বাড়ি ও খেতের বেড়া দেওয়া হয়। ফুলগাছ না হয়েও তার ফুলগুলো যেন ‘স্বর্গভোলা পারিজাতের গন্ধখানি এসে/ খ্যাপা হাওয়ায় বুকের ভিতর ফিরবে ভেসে ভেসে’।

দেবকাঞ্চনের গোলাপি লাল ফুলগুলো দেখে মনে হয়, ডালে ডালে যেন প্রজাপতির মেলা বসেছে। না, সত্যি প্রজাপতি নয়। প্রজাপতির মতো লাল গোলাপি অজস্র ফুলে ভরে আছে দেবকাঞ্চনের গাছ। পাতাহীন। কিন্তু ফুল তার সব ডাল ঢেকে রেখেছে। একইভাবে সাদা থোকা ধরা কুরচি ফুল ডালকে সাজিয়ে রাখে আপন মমতায়। এ দৃশ্য দেখতে হলে যেতে হবে বান্দরবানের পাহাড়ে পাহাড়ে।

ফুলগাছ না হয়েও চেরি আর কুরচির মতো স্বাদ পাইয়ে দেয় ফুলে ভরা শজনেগাছগুলো। ফাগুনে গ্রামীণ পথে ও বসতবাড়িতে শজনের এ এক অপূর্ব উপহার। দক্ষিণাঞ্চলে জলাভূমিতে আর এক ধরনের মান্দারগাছ জন্মে। এগুলোকে বলা হয় পানিয়া মান্দার। ফাগুনে সেসব গাছেও থোকা ধরে ফোটে খয়েরি লাল ফুল। এসব ফুলের গন্ধ নেই, কিন্তু অজস্র ফুলের বাহারি শোভা আছে। এ সময় ফুটতে শুরু করে অশোক।

বসন্তে ফোটা মাধবীর কথা না বললেই নয়। আমরা যাকে মাধবীলতা বলে জানি, সে আসলে মধুমঞ্জরি বা মাধুরীলতা। এর ফুলগুলো গোলাপি সাদা, থোকা ধরে ফোটে বসন্ত থেকে বর্ষা পর্যন্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই এর নাম রেখেছিলেন। তাঁর কথায় ‘বসন্তের মাধবী মঞ্জরী/ মিলনের স্বর্ণপাত্রে সুধা দিল ভরি।’ মাধবীলতার ফুলগুলো সাদা বা ঘিয়া রঙের, ছোট, অত্যন্ত সুঘ্রাণযুক্ত। রমনা উদ্যানে মাধবীলতার গাছ আছে। ফাগুনে আরও দুটি ফুল ফোটার সূচনা হয়—নাগেশ্বর বা নাগকেশর ও মুচুকুন্দ বা কনকচাঁপা। এ দুটি ফুলের শোভা আহামরি কিছু না হলেও বসন্তে তারা ইন্দ্রজাল রচনা করে। কবির ভাষায় ‘বসন্তে নাগকেশরের সুগন্ধে মাতাল/ বিশ্বের জাদুর মঞ্চে রচে সে আপন ইন্দ্রজাল।’

বসন্ত সাজে খোঁপায় গোজার মতো সেরা ফুল হলো করবী। সাদা ও লাল করবী ফুলেরা ফাগুন থেকে থোকা ধরে ফুটতে শুরু করে। সঙ্গ দেয় সারা বছর ধরে ফোটা জবা ও রঙ্গন ফুলেরা। ‘বকুল শিমুল আকন্দফুল/ কাঞ্চন জবা রঙ্গনে/ পূজা তরঙ্গ দুলে অম্বরময়।’ মালার জন্য বকুল এক অসাধারণ ফুল। মালার জন্য এ সময় ফোটা শুরু করে টগর ফুলেরা। ফাগুন হলো মন সাজানোর আর বসন্ত হলো বন সাজানোর ঋতু। তাই তো বনে বনে ফাগুনে শুরু হয় অনেক বনফুল ফোটার পালা। আকন্দ আর ভাঁটফুল এগুলোর অন্যতম। পথের ধারে গ্রামীণ জঙ্গলে এ দুটি ফুল এ সময় চোখে পড়বেই।