ফাতাহ-হামাস ঐক্য এবার টিকবে তো?

আবারও অনিশ্চয়তার আবর্তে পড়ল ফিলিস্তিন-ইসরায়েল শান্তি আলোচনা। সমঝোতায় পৌঁছাতে মধ্যস্থতাকারী যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষকে একটা সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল। গত ২৯ এপ্রিল সে সময়সীমা শেষ হয়েছে কোনো অগ্রগতি ছাড়াই।
মধ্যপ্রাচ্য শান্তি-প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে ‘আবার অনিশ্চয়তার আবর্তে’ গোছের শিরোনাম সাংবাদিকেরা কতবার ব্যবহার করেছেন, তার লেখাজোকা নেই। তবে অন্যবারের তুলনায় এবারের আলোচনার নিষ্ফলতার মধ্যে একটি চোখে পড়ার মতো পার্থক্য রয়েছে। সেটি হচ্ছে ইহুদি বসতিতে হামাসের রকেট হামলা বা তেল আবিবের রেস্তোরাঁয় বোমা বিস্ফোরণের মতো ঘটনা নয়, আলোচনা ভেস্তে গেছে দ্বিধাবিভক্ত ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের ঐক্যের উদ্যোগের জেরে। বহু কাঠখড় পোড়ানোর পর ফিলিস্তিনিদের দুই প্রধান পক্ষ ইসলামপন্থী হামাস আর ধর্মনিরপেক্ষ ফাতাহ এক হওয়ার জন্য সমঝোতায় পৌঁছায় গত মাসের শেষ দিকে। এর প্রতিক্রিয়াতেই ইসরায়েল চলমান সংলাপ বন্ধ করে দেয়।
তিন বছরের বিরতির পর গত বছরের জুলাইয়ে শান্তি আলোচনা নতুন করে শুরু হয়েছিল। তবে বিশেষ অগ্রগতি হয়নি। আর এবার তা বন্ধই হয়ে গেল। হামাসকে অপছন্দ করা যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার তাগিদ দিলেও ইসরায়েলের দিক থেকে ইতিবাচক সাড়া নেই।

যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বের অনেকে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধানের’ চেষ্টা করছে। তাদের প্রত্যাশা, এর মাধ্যমে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দুটি আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিকারী হলে ওই অঞ্চলে শান্তি আসবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এবারের আলোচনার ব্যর্থতা সেই দুই রাষ্ট্রমুখী সমাধানের সম্ভাবনাকে অনিশ্চয়তায় ফেলল। ইহুদি বসতি নির্মাণ ও বন্দীমুক্তি নিয়ে মতের অমিল এমনিতেই বেশ কয়েকবার আলোচনায় বাদ সেধেছে। গত ২৩ এপ্রিল ফিলিস্তিনিদের এত দিন বিভক্ত হয়ে থাকা দুই প্রধান পক্ষ সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করলে চলমান শান্তি-প্রক্রিয়া একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ে। হামাস ও ফাতাহর চুক্তিতে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে ঐক্যের সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। এরপর ছয় মাসের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন হবে। এ ছাড়া নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পুনর্গঠন, সামাজিক আপস-মীমাংসা এবং নাগরিকদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বর্তমান পরিস্থিতি যা, তাতে হামাস ও ফাতাহর পুনর্মিলনের উদ্যোগে সাময়িকভাবে হলেও দৃশ্যত শান্তি আলোচনার পথ বন্ধ হয়ে গেল। কারণ, ইসরায়েল বলে দিয়েছে, হামাসকে সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করেছে, এমন কোনো পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না তারা। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ফাতাহ প্রধান ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি অথবা হামাসের সঙ্গে চুক্তি-যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হবে।
হামাস ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে না। অন্যদিকে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র বেশ কিছুসংখ্যক
দেশ সংগঠনটিকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে বিবেচনা করে। বর্তমাসে হামাসের নেতৃত্ব দিচ্ছেন খালেদ মেশাল৷
দুই ফিলিস্তিনিদের এক হওয়ার খবরে যারা খুশিতে আটখানা, তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন পর্যবেক্ষকেরা। মনে করিয়ে দিয়েছেন ঐক্যের জন্য হামাস ও ফাতাহর অতীত চেষ্টার পরিণতির কথা। ফিলিস্তিনি উপদল দুটি তিক্ত বিরোধের কারণে ২০০৭ সাল থেকে বিভক্ত। কখনোই কাঠামোগত ঘনিষ্ঠতা বলতে কিছু ছিল না তাদের মধ্যে। হামাস এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জনে সংগ্রামের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) সদস্যই হয়নি। ১৯৬৯ সাল থেকে এ সংগঠনে ফাতাহরই প্রাধান্য। হামাস ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে তখনকার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাধারণ নির্বাচনে জেতার পর ফাতাহকে জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালেও তারা সাড়া দেয়নি। ২০১১ সালে কায়রো এবং ২০১২ সালে দোহাতে স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। উভয়ের মধ্যেই আন্তরিক অঙ্গীকার আর অভ্যন্তরীণ মতৈক্যের অভাবকে এ জন্য দায়ী করেছেন পর্যবেক্ষকেরা। ২৩ এপ্রিলের এ সর্বশেষ দফা চুক্তি নিয়ে বেশির ভাগ ফিলিস্তিনির মাতামাতি না করার কারণ এটাই।
তবে আগামীর ছবিটা পুরোটাই হতাশার কালিতে আঁকা নয়। ফাতাহ ও হামাস ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে পারলে তারা এবার হয়তো অচলাবস্থার একটা অবসান ঘটাতে পারবে। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় অগ্রাধিকার দিলে তারা নিজের জনগণের কাছে অনেকখানি বৈধতা ফিরে পাবে। গাজা ও পশ্চিম তীরে দুই সরকারের বিভক্ত হয়ে থাকার অবসান ঘটবে। ইসরায়েলের সঙ্গে সমস্যাসংকুল শান্তি আলোচনায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রতি আন্তর্জাতিক বিশ্বের আস্থা ফিরিয়ে আনারও বড় উপায় হতে পারে এটি। এতে মার্কিন একচেটিয়া (এবং গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ) কূটনৈতিক তৎপরতার বৃত্তে বন্দী না থেকে ইউরোপের একটি বৃহত্তর ভূমিকার পথ সুগম হতে পারে। সন্দেহপ্রবণ আরব দেশগুলোকেও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রতি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যের হাত বাড়াতে উৎসাহিত করতে পারে এই ঐক্য। মার্কিন ও ইসরায়েলি শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে তা খুবই দরকার ফিলিস্তিনের জন্য।
সমঝোতা চুক্তি হলো। এর পর কী? বিশেষজ্ঞদের জবাব, ফিলিস্তিনিদের জন্য সামনের কাজটি সহজসাধ্য হবে না। এর জন্য মূল্য দিতে হবে চড়া। কিন্তু প্রাপ্তির বিষয়টি অনিশ্চিত। তবে একই সঙ্গে পর্যবেক্ষকেরা এ-ও মানেন, প্রতিবন্ধকতাগুলো উপেক্ষা করার মতো না হলেও আবার দুর্লঙ্ঘও না। এর মধ্যে প্রথম ও সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটা স্পষ্ট যে স্বল্পমেয়ািদ বিবেচনা থেকেই ফিলিস্তিনি নেতারা ২৩ এপ্রিলের চুক্তি সই করেছেন। পরিস্থিতির বড় ধরনের পরিবর্তন হলেই যে তাঁরা চুক্তিটি ভুলে যাবেন, তা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু ফাতাহ ও হামাসকে নতুন যাত্রাপথে অবিচল থাকার জন্য জান দিয়ে লাগতে হবে। এ ছাড়া মূল স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ও আদর্শগত বিষয়ে কিছু কিছু ছাড় দেওয়ার জন্য উভয় পক্ষকেই সমানভাবে আগ্রহী হতে হবে।
সমঝোতার পেছনে উভয়ের কৌশলগত ভাবনাই কিন্তু ওয়াকিবহাল পর্যবেক্ষকের কাছে পরিষ্কার। মিসরের সেনা-সমর্থিত সরকার গাজা সীমান্ত দিয়ে বাণিজ্য ও যাতায়াত প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এতে সেখানকার হামাস প্রশাসনের আয়ের পথ সংকুচিত হয়ে গেছে অনেকটাই। অন্যদিকে, পশ্চিম তীরে ফাতাহকে দেওয়া কাতারের সহায়তা অব্যাহত থাকা নিয়ে আছে অনিশ্চয়তা। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ দুই দলের জন্যই দরকার।
যা-ই হোক, ফাতাহ ও হামাসকে সাফল্য পেতে হলে সম্ভাব্য সব উপায়ে জাতীয় ঐক্যকে বাস্তব রূপ দিতে হবে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য একটি সরকার গঠন করতে হলে মন্ত্রিসভার পদের ক্ষেত্রে উভয়কে ছাড় দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। রাষ্ট্রীয় অর্থব্যয়ের বিষয়টিকে স্বচ্ছ ও যৌথ জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। হামাস ও ফাতাহকে সত্যিকার অর্থেই গড়তে হবে এক ‘ঐতিহাসিক জোট’। হামাসকে যেমন তাদের দলের বেশি উগ্র পক্ষটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, তেমনি ফাতাহকে থামাতে হবে তাদের মধ্যকার গোষ্ঠীকোন্দল।
সূত্র: সিএনএন,বিবিসি ও দ্য গার্ডিয়ান